পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ বেলুচিস্তান। খনিজ সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটির লোকজন স্বাধীনতার দাবিতে বেশ কয়েক দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এটি এখন পাকিস্তানের অন্যতম বড় নিরাপত্তা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবশেষ ইরান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলটিতে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) একটি ট্রেন ছিনতাই করে। এ পর্যন্ত ট্রেনে জিম্মি হওয়া ৩০০ জনের বেশি যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ট্রেনটিতে চালানো অভিযানে নিহত হয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীর ৩৩ জন সদস্য।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, বিদ্রোহীরা কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে বলান পার্বত্য অঞ্চলে হামলা করে। এ ক্ষেত্রে প্রথমে তারা রেললাইনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ট্রেনটিকে থামিয়ে দেয় এবং এটিকে মাশকাফ টানেলের ভেতর আটকে ফেলে। ঈদুল ফিতরের আগে ট্রেনটি দিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ ও কর্মকর্তারা বাড়ি ফিরছিলেন।
বিশ্লেষকদের মতে, এই ছিনতাইয়ের ঘটনাটি বালুচ আন্দোলনে একটি নতুন পর্বের সূচনা করেছে। বলা হচ্ছে, এই বিদ্রোহের মূলে রয়েছে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিশ্বাসঘাতকতা। যদিও তিনি চাননি বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হোক। তিনি প্রদেশটির স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি বেলুচিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছিল। এই দেশটির চারটি রাজ্য নিয়ে গঠিত হওয়ার কথা ছিল-খারান, মাকরান, লাস বেলা এবং কালাত। দেশভাগের আগে, এই রাজ্যগুলোকে তিনটি বিকল্প দেওয়া হয়েছিল-হয় ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেওয়া অথবা স্বাধীন থাকা। কালাতের প্রধান খান মীর আহমেদ ইয়ার খান শেষ বিকল্পটি বেছে নেন। বাকি রাজ্যগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়।
জিন্নাহও প্রথমে কালাতের স্বাধীনতা স্বীকার করেছিলেন। ইয়ার খান জিন্নাহর ওপর আস্থা রেখেছিলেন। কারণ তাঁরা ছিলেন বন্ধু।
কালাত ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে, কিন্তু ব্রিটিশরা আশঙ্কা করেছিল যে সম্প্রসারণবাদী শাসনের হুমকির কারণে কালাতকে স্বাধীন থাকতে দেওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য তারা কালাতকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পাকিস্তানকে চাপ দেয় এবং তখনই জিন্নাহ ইউ-টার্ন নেন।
১৯৪৭ সালের অক্টোবরে জিন্নাহ ইয়ার খানকে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সশস্ত্রগোষ্ঠী বিএলএ সংগঠনটি দাবি করে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে স্বায়ত্তশাসিত ‘কালাত খানাত’ বা বালুচ খানাতকে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে পাকিস্তানে সংযুক্ত করা হয়েছিল।
তাজ মোহাম্মদ ব্রিসেগ তাঁর ‘বেলুচ ন্যাশনালিজম: ইটস অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে আপ টু ১৯৮০’ বইটিতে লেখেন, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বেলুচিস্তানকে পাকিস্তানে যোগ দিতে বাধ্য করার জন্য কেবল অভিযানই শুরু করেনি। তারা রাষ্ট্রের জোরপূর্বক সংযুক্তির জন্য বলপ্রয়োগমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করতেও প্রস্তুত ছিল।
১৯৪৮ সালের ১৮ মার্চ জিন্নাহ খারান, মাকরান, লাস বেলা রাজ্য পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির ঘোষণা দেন। এতে কালাত স্থলবেষ্টিত হয়ে যায় এবং এর ভূখণ্ডও কমে যায়। ওই সময় আরও একটি খবর প্রকাশিত হয় যে, কালাত ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে চায়। এ খবর পাকিস্তানকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এ সময় অন্যান্য আন্তর্জাতিক দেশ থেকে সাহায্য না পেয়ে বালুচ নেতারা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়।
বেলুচিস্তান থেকে দ্বিতীয় বিদ্রোহটি শুরু হয় ১৯৫৪ সালে যখন পাকিস্তান তার প্রদেশগুলোকে পুনর্গঠনের জন্য এক-ইউনিট পরিকল্পনা চালু করে। ব্রেসগের মতে, ১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর সঙ্গে বেলুচিস্তান স্টেটস ইউনিয়নের সংযুক্তির পর অবহেলা ও বঞ্চনার বেলুচদের অনুভূতি আরও গভীর হয়ে ওঠে এবং তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে কালাতের খান নবাব নওরোজ খান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, কিন্তু ১৯৫৯ সালে তিনি প্রতারিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন।
মীর আহমদ ইয়ার খান বালুচ তাঁর ‘ইনসাইড বেলুচিস্তান’ বইয়ে লেখেন, ‘আমি নিজেকে সেই সেনাবাহিনীর কাছে সমর্পণ করেছিলাম যারা আমার সঙ্গে কালাতের রাস্তা ও রাস্তায় প্যারেড করেছিল। সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ফলে আমি আমার বেশ কয়েকজন লোককে মাটিতে পড়ে যেতে দেখেছি। আমি যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম এবং লাহোরের কারাগারে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।’
১৯৬৩ সালে শের মুহম্মদ বিজরানী মারি বেলুচিস্তানে তৃতীয় বিদ্রোহ করে। শের মুহম্মদ জেনারেল শেরফ নামেও পরিচিত। তিনি পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহার, ওয়ান ইউনিট প্ল্যান বাতিল এবং বেলুচিস্তানকে একটি প্রদেশ হিসাবে পুনরুদ্ধারের দাবিতে জাতীয়তাবাদীদের একটি দলকে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের স্থলাভিষিক্ত হয়ে সরকারের প্রধান হন এবং একটি যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন। এক বছর পর, পশ্চিম পাকিস্তানে ওয়ান ইউনিট প্ল্যান বাতিল করা হয় এবং পাঞ্জাব, সিন্ধু ও সীমান্ত ছাড়াও বেলুচিস্তানকে একটি প্রদেশ করা হয়।
সত্তরের দশকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফলে বালুচরা উৎসাহিত হয় এবং বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো তা প্রত্যাখ্যান করেন, যা ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত করে এবং ১৯৭৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেলুচিস্তানে আকবর খান বুগতির প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করে।
এই পাকিস্তান বিক্ষোভ দমন করতে একটি বড় আকারের অভিযান শুরু করে। এসময় একটি সশস্ত্র বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। তখন বেলুচিস্তানের হাজার হাজার সশস্ত্র উপজাতি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল । জেনারেল জিয়া-উল-হক ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চার বছর স্থায়ী ছিল। পরে বালুচদের ক্ষমা করা হয় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের বেলুচিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
বেলুচিস্তানের পঞ্চম সংঘাত শুরু হয় ২০০৫ সালে। ওই সময় এক বালুচ নারী চিকিৎসক সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। এরপর গত কয়েক বছর ধরে বিএলএ পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। তবে খনিজ সম্পদ আহরণ প্রকল্পগুলোই তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু। পর্বতসংকুল এই অঞ্চলটি বিদ্রোহীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবেও পরিচিত। বালুচরা প্রায়ই তাদের রাজ্যে কর্মরত চীনাদের ওপর হামলা চালায়। বিশ্লেষকদের মতে, তারা মূলত চীনাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়। তারা বিশ্বাস করে যে, আতঙ্কিত হয়ে বেলুচিস্তান সংকট সমাধানে পাকিস্তানকে চাপ দেবে চীন।
পাকিস্তানের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে কম জনবহুল প্রদেশ বেলুচিস্তান সবসময়ই স্বাধীন হওয়ার পক্ষে। বেলুচিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা জার্নাল অনুসারে, ব্রিটিশরা রাশিয়ার মতো সম্প্রসারণবাদী চিন্তা থেকে তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এই অঞ্চলকে একটি ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু একটি শক্তিশালী প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত এখানে তারা হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করে।
কিন্তু ভারত বিভাজনের পর পাকিস্তান বালুচ নেতাদের তাদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য বাধ্য করলে পরিস্থিতি বদলে যায়। এটি স্থানীয়দের কাছে ভালো লাগেনি। পরে তারা তাদের স্বাধীন বেলুচিস্তানের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আরও আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করে।
বালুচরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্পদের শোষণ এবং অবহেলার অভিযোগ করে যাচ্ছে। যা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জাতিগত অসন্তোষ এবং তীব্র ক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে। বিএলএ এবং বেলুচিস্তান লিবারেশন ফ্রন্টের (বিএলএফ) মতো বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বাধীনতার দাবিতে এখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। বেলুচিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে গত কয়েক বছরে এই সংঘাত আরও খারাপ হয়েছে। বালুচরা অভিযোগ করেছেন যে, তাদের আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী শত শত কর্মী ও বেসামরিক নাগরিককে জোরপূর্বক নিখোঁজ করেছে।
তথ্যসূত্র:ডন, ইনডিপেনডেন্ট, এনডিটিভি,বিবিসি