গত দুই দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে উদীয়মান শক্তিগুলোর অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী জোট হিসেবে ব্রিকস বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে গঠিত এই জোট বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা প্রভাবের বিকল্প পথ দেখাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। তবে জোটটির অভ্যন্তরীণ বিভাজন, বিশেষ করে রাশিয়ার ইউক্রেন সামরিক আগ্রাসন এবং চীনের একক আধিপত্যের চেষ্টায় জোটটি কার্যকর শক্তি হিসেবে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে আলোচনায় এসেছে আরেক পুরোনো ত্রিদেশীয় জোট– আইবিএসএ। ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে গঠিত এই জোটের মূল লক্ষ্য ছিল, উন্নয়নশীল বিশ্ব বা গ্লোবাল সাউথের সহযোগিতা, বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং গণতান্ত্রিক উদীয়মান শক্তিগুলোর সম্মিলিত কণ্ঠস্বর জোরালো করা। কিন্তু ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই আইবিএসএ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় জোটটির পুনর্জাগরণের প্রয়োজনীয়তা আবার সামনে এসেছে।
ব্রিকসের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিকসের অভ্যন্তরীণ অবস্থান ক্রমেই বিপরীতমুখী হয়ে উঠছে। রাশিয়ার আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা কিছুটা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু একই সময়ে চীন ও রাশিয়া ব্রিকসকে স্পষ্টভাবে একটি পশ্চিমাবিরোধী মঞ্চে রূপান্তর করতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন সদস্য যেমন ইরান, ইথিওপিয়া, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়াকে যুক্ত করার ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা বেড়েছে। ব্রিকসের চলতি বছরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক থেকে কোনো যৌথ বিবৃতি না আসা সেই সংকটেরই ইঙ্গিত।
ব্রিকসে মতভেদ শুধু ভূরাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। কেউ কেউ ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থার পক্ষে, আবার কেউ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের বিরোধী। এই মতানৈক্যের ফলে সদস্যদের স্বার্থ ও আশা বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ছে।
আইবিএসএ’র সম্ভাবনা
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইবিএসএ আবারও গুরুত্ব পাচ্ছে। তিনটি সদস্য দেশই গণতান্ত্রিক, বৈচিত্র্যপূর্ণ অর্থনীতি এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে। ব্রিকসের তুলনায় আইবিএসএ সদস্যরা বহুমুখী কূটনীতির পক্ষপাতী, যা বর্তমান বিশ্বের অস্থির ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ।
ফরেন পলিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে গ্লোবাল সাউথের জন্য একটি বিকল্প প্ল্যাটফর্ম থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্ক ছিল উত্যপ্ত। নতুন করে সেই উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও ব্রাজিল ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। আইবিএসএ সেই কূটনৈতিক সেতুবন্ধন হিসেবেই কাজ করতে পারে।
এ ছাড়া জলবায়ু সংকট, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও বাণিজ্য ব্যবস্থার সংস্কারের মতো বিষয়েও আইবিএসএ তিনটি দেশের অভিজ্ঞতা ও মতামত একত্রিত হলে, তা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশের জন্য সহায়ক হতে পারে।
আইবিএসএর সূচনা থেকেই বাস্তব নীতিগত পদক্ষেপ দেখা গেছে। ২০০৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) ট্রিপস চুক্তির বিরুদ্ধে আইবিএসএর অবস্থান নেওয়ার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থায় জেনেরিক ওষুধ রপ্তানির অনুমোদন পায়, যা পরবর্তীতে এইচআইভি/এইডস ও করোনা মহামারির সময় কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একসময় বলেছিলেন, ‘আজকের অস্থির পৃথিবীতে আইবিএসএ এক ধরনের নৈতিক শক্তি।’
নতুন চ্যালেঞ্জ
আইবিএসএর নতুন শুরু ও প্রভাব বিস্তার সহজ নয়। তিনটি দেশই বর্তমানে নিজ নিজ কৌশলগত অগ্রাধিকার নিয়ে ব্যস্ত। ভারত কোয়াডে, ব্রাজিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তির দিকে, আর দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিলতায় জর্জরিত।
কিন্তু আইবিএসএ যদি গবেষণা, মানবাধিকার, তথ্যপ্রবাহ, গণতন্ত্র নিয়ে নিজস্ব ফোরাম গড়ে তোলে, তাহলে তা কেবল তিন দেশের জন্য নয়, বরং গোটা দক্ষিণাঞ্চলের জন্য একটি বিকল্প নীতিগত প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পারে। এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ কূটনৈতিক পরিসর আজকের বিভক্ত বিশ্বে চ্যালেঞ্জ বলা যায়।
আইবিএসএ ব্রিকসের বিকল্প নয়, বরং একটি পরিপূরক প্ল্যাটফর্ম। বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থা যতটাই বিভক্ত এবং সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে, ততই উদীয়মান গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা, নীতিগত ঐক্য ও বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আইবিএসএ সেই সম্ভাবনার পথ দেখাতে পারে। এটি কেবল শুধু গ্লোবাল সাউথের নয়, গোটা বিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি, দ্য ইকোনমিক টাইমস