মে মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে, যার ফলে দলটি আগামী বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনের পর সেই আইনের আইনের আওতায় এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এ আইন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে বিরোধীদের দমনে ব্যবহৃত হয়েছে উল্লেখ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বাংলাদেশের উচিত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের আদেশ তুলে নেওয়া এবং দলটিকে সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্মের পরপর হওয়া সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে সর্বশেষ অভ্যুত্থানের তুলনা টানা হয়। এতে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মাত্র চার বছরেই নিভে যায়। গত বছর বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে, যাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান হয়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় মুক্তি আরও দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে একটি ছাত্রনেতৃত্বাধীন আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়। এরপর একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, যার নেতৃত্ব দেন ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ ও জাতীয় নায়ক মুহাম্মদ ইউনুস। এই সরকার দেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে প্রায় এক বছর পর এই নতুন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউনূস এবং তাঁর তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের হাতে অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ তুলে দেওয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার আমলে বছরের পর বছর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছিল। দুর্নীতি ছিল সর্বত্র ও প্রকাশ্য। সরকারবিরোধীদের ওপর চালানো হতো হামলা।
একটি আকর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীর হয়ে যায়। তখন বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশি ছিল তরুণ বেকার। ক্ষুব্ধ বিপ্লবীদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার সরকারকে সহায়তাকারীদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
নতুন সরকার কিছু অগ্রগতি করেছে। তারা সতর্কভাবে জানিয়েছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থনীতি ধীরগতির হলেও স্থিতিশীল। মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা ঋণ দিচ্ছে।
তবে তাদের কিছু পদক্ষেপ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। বিদেশনীতিতে বাংলাদেশ চীনের দিকে হেলে পড়েছে–বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সস্তা অস্ত্রের আশায়। এটি আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ককে বিপদে ফেলছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সাহায্য হ্রাসের আগ পর্যন্ত অন্যতম বড় দাতা ছিল। চীনের দিকে এই ঝোঁক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোয় ভারতও ক্ষুব্ধ। গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নতির দিকে ছিল, কিন্তু এখন সেই সম্পর্ক ক্ষয়প্রাপ্ত।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারত একটি ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল করেছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে লাভবান হতো। পাশাপাশি ভারত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছে। এখন তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী-চুক্তি পুনর্বিন্যাস করতে চাইছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউনূসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে পুনর্গঠন করা। এর অর্থ দেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন ও অন্যান্য বিষয়ে নতুন নিয়মে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। তবে রাজনীতিবিদদের এই প্রক্রিয়ার প্রতি ধৈর্য ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলছে। রাজনৈতিক মতবিরোধ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনারকে জনতা মারধর করে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সহায়তা করে ক্ষমতায় বসতে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।
মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বড় ভুল করে বসে। তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করে, যার ফলে দলটি আগামী বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। যদিও আদালত দলীয় নেতাদের অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, তবু কিছুদিন আগেও আশা ছিল যে, দলটির সাধারণ সদস্যরা তাদের আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ পাবে।
এই নিষেধাজ্ঞা একটি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনের মাধ্যমে প্রণীত হয়, যা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্লেষকদের মতে, এটি সেই ধরনের কুৎসিত কৌশলের ইঙ্গিত দেয়, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে বিরোধীদের দমন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি বাংলাদেশকে প্রতিশোধমূলক এক চক্রে ফিরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। দেশটিতে যারাই ক্ষমতায় থাকে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করতে ক্ষমতা ব্যবহার করে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উচিত আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণের আদেশ তুলে নেওয়া এবং দলটিকে সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। অনেক নাগরিক হয়তো এটি অপছন্দ করবেন–তবে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দলটির সবাই দোষী নন। দলটির এখনও উল্লেখযোগ্য সমর্থন রয়েছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। বছরের পর বছর অনিয়মিত নির্বাচনের পর, এই ভোটারদের যাকে খুশি ভোট দেওয়ার অধিকার থাকা উচিত।
বিশ্লেষকদের ধারণা, আওয়ামী লীগকে প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও তারা জয়ী হবে না। তবে সংসদে তাদের উপস্থিতি বিরোধী দলগুলোর অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে, যা বিজয়ীদের নজরদারিতে রাখতে সহায়ক হবে। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রতিশোধ নয়, প্রয়োজন সমঝোতা।