মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট শুকরিয়া আদায়, যাবতীয় অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী এবং অনুতপ্তকারীকে ক্ষমা করা—ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাগি’তে এসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন নির্মাতা শিহাব শাহীন। সিনেমাটি দেখলে মনে হয় যে, অপরাধের অপর পিঠে তিনি এক ‘অনুশোচনা বা মায়ার গল্প’ বুনতে চেয়েছেন।
দাগি’র শুরুটা একজন ১৪ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির আকস্মিক মুক্তি পাওয়ার মধ্যদিয়ে। দিনটি বিজয় দিবস। কারাগার থেকে মুক্তি পায় অনেক বছর আগের এক চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি, যার নাম ‘নিশান’। ভালো কাজের উপহার স্বরূপ নির্ধারিত কারাভোগের আগেই কারা অধিদপ্তর তার সাজা মওকুফ করেছে। কিন্তু নিজের এলাকায় নিশান এক ত্রাস! তার আকস্মিক মুক্তিতে গোটা এলাকা অবাক! কিছুটা ভীতসন্ত্রস্তও বটে। এমনকি নিশানের ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি তার বাবা-মায়ের কাছেও অবিশ্বাস্য! সিনেমাটিতে এমনই এক ‘দাগি’র আখ্যান চিত্রায়িত করেছেন নির্মাতা।
দুনিয়া বিপৎসংকুল, এক অপরাধ আরেক অপরাধকে ডেকে আনে!—কারাগার থেকে মুক্তির সময় তাই কিনা নিশানকে একজন সাবধান করে দেয় এই বলে যে—‘জেলের দাগ একবার যার লাগছে সেই দাগি, সারাটা জীবন!’
অর্থাৎ জেল থেকে মুক্তি পাওয়াই শেষ কথা নয়! বরং নিশানকে সামনে আরও বেশ জটিল জীবনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে! পর্দায় সেসব পরিস্থিতিই নাটকীয়ভাবে ফুটে উঠে।
লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান!
এ সিনেমায় কিছু মুহূর্ত রয়েছে, যেখানে দর্শকরা আফসোস করতে পারেন! অর্ণবের গানের সুরে বলতে পারেন, ‘হোক কলরব ফুলগুলো সব / লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান?’ অর্থাৎ একটি ঘটনা এমন না হয়ে ‘অমন’ হলেই নিশানের জীবন হতো সুন্দর, নির্ঝঞ্ঝাট! সিনেমাটি দেখে দর্শকরা যেমন একদিকে আফসোসের সুরে ভাসতে পারেন, অন্যদিকে আবার তীব্র ক্ষোভেও ফেটে পড়তে পারেন! তবে আফসোস বা ক্ষোভ—যে সুরেই বাজুক না কেন দর্শকের মন, প্রতি মুহূর্তে দায়িত্ববোধের কথাই মনে করিয়ে দেন নির্মাতা। যেখানে মিশে আছে কিছু আবেগ।
সংলাপে ছুঁয়ে দিল মন
দাগিতে দর্শকের মন ছুঁয়ে যেতে পারে বেশ কিছু সংলাপে। যেগুলো কখনও ভাবায়, আবার কখনও হাসায়। যেমন, ‘জেলের দাগ একবার যার লাগছে সেই দাগি, সারাটা জীবন!’, ‘অপরাধবোধের একটা পাথর না বুকের ভিতর চাপ দিয়ে ধরে রাখে!’, ‘কুত্তামারা হ্যান্ডসাম’ কিংবা ‘ক্ষমা চাইতে সাহস লাগে, অনেক ক্ষমতাশালীর পতন হইছে ক্ষমা চায় নাই বইলা’।
রোমান্সের লাল-নীল ঘুড়ি
পর্দায় প্রেম-ভালোবাসার গল্প বলায় জুড়ি মেলা ভার নির্মাতা শিহাব শাহীনের। দাগি চলচ্চিত্রেও সেই ছাপ স্পষ্টভাবেই উপস্থিত। বলতে গেলে, নাটাই নিজের হাতে রেখে রোমান্সের লাল-নীল ঘুড়ি উড়িয়েছেন নির্মাতা!
সম্পর্কের জটিল সমীকরণ
সিনেমাজুড়ে রয়েছে বেশকিছু চরিত্রের উপস্থাপন, যারা একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। গল্পটি সম্পর্কের এক জটিল সমীকরণে গাঁথা।
উপরে উল্লেখিত এমন নানা বিষয় নজর কাড়ে দাগিতে। আর গল্পটিও সরলরৈখিক নয়, মানে একসঙ্গে নানাদিকে আলো ফেলেছেন নির্মাতা। ফলে গল্পের একদিকে হেলে পড়া যায় না!
এ সিনেমায় দাগি নিশানের ভূমিকায় রয়েছেন আফরান নিশো। পর্দায় তাঁকে বেশ কয়েকটি লুকে দেখা যায়, সিনেপ্রেমী কিংবা অভিনেতার ভক্তদের মনে যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। এমন দুর্দান্ত উপস্থাপন নির্মাতা শিহাব শাহীনের মুনশিয়ানাও বটে। তবে এক-দুটো দৃশ্যে সংলাপ বলার ক্ষেত্রে আফরান নিশোর স্বকীয় বাচনভঙ্গি প্রকাশ পায়, যার সঙ্গে দর্শকরা আগে থেকেই পরিচিত! এই ‘মুদ্রাদোষ’ ব্যতীত গোটা সিনেমায় আফরান নিশো অনবদ্য।
নিশানের প্রেমিকা জেরিন চরিত্রে রয়েছেন তমা মির্জা। এক কথায় তিনিও স্বতঃস্ফূর্ত। আবার ঘটনাচক্রে ‘লিখন’ নামের অন্য একটি মেয়ের সঙ্গেও নিশানের পরিচয় ঘটে। সেই লিখন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুনেরাহ বিনতে কামাল। এই চরিত্রে যতটা অভিনয়ের অবকাশ রয়েছে, সেটা পুরোমাত্রাই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, ‘রবি’ নামের দুর্ধর্ষ এক চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাশেদ মামুন অপু। বিরতি শেষে সিনেমাটি জমিয়ে দেন তিনি। এ ছাড়া অন্যান্য ভূমিকায় শহীদ্দুজামান সেলিম, গাজী রাকায়েত, মিলি বাশার, মনোজ প্রামাণিক, এ কে আজাদ সেতু, রাজীব সালেহীনসহ সবাই পরিমিতবোধ নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন।
দাগি’র আবহসংগীত আর গানগুলোও দৃশ্যের সঙ্গে মানানসই। দর্শকের মাঝে আলাদা এক অনুভূতি ছড়িয়ে যায়। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিংসহ অন্যান্য বিষয়াদিও সাবলীল।