দেশের সিনেমা অঙ্গনে ‘সাউথ ইন্ডিয়ান’ সিনেমার ছোঁয়া লেগেছে জোরেসোরে! বিশেষ করে ঈদ মৌসুম এলে সেটা আরও ভালো করে টের পাওয়া যায়। বেশির ভাগ সিনেমায় ভায়োলেন্স, হিরোইজম, মারমার-কাটকাট প্রেজেন্টেশনের জয়জয়কার। ঠিক সেই সময়ে মুক্তি পেয়েছে ভিন্নধর্মী ‘উৎসব’। ভিন্নধর্মী কেন - সেটার ধারণা মিলেছিল ট্রেলারেই। বড় পর্দায় তা কতটা উৎসব জমল?
সিনেমার শুরুটা ‘খাইস্ট্যা জাহাঙ্গীর’কে দিয়ে। শুধু শুরুটা নয়- পুরো গল্পটাই আবর্তিত হয়েছে মোহাম্মদপুরের শান্তিনীড়ের বাসিন্দা এক ডেকোরেটর ও ক্যাটারিং ব্যবসায়ীকে নিয়ে। জাহাঙ্গীরের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার ছেলে-পেলে তাঁর বাসার সামনে বড় করে ব্যানার টানিয়েছে, যেখানে লেখা ‘খাইস্ট্যা জাহাঙ্গীর উষ্ঠা খাক, শান্তিনীড় মুক্তি পাক।’
কেন জাহাঙ্গীরকে সবাই খাইস্ট্যা বলে, কেন তাঁর জ্বালায় প্রতিবেশীরা অতিষ্ঠ?
জাহাঙ্গীর মিতব্যয়ী, সোজা বাংলায় বললে কিপটে। সেইসঙ্গে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক। তাঁর মধ্যে সম্পর্কের জন্য নেই কোনো মমত্ববোধ। সে নিজে আনন্দ করে না, অন্যকেও আনন্দ করতে দেয় না। তার ব্যবসার কর্মচারীদের ঈদের ছুটি পর্যন্ত একদিনের বেশি দিতে চান না। মুখের ওপর বলে দেন, ‘দুই দিনের দুনিয়ায় ছুটি নেবেন তিনদিন?’
এমন রুক্ষ আর তিরিক্ষি মেজাজের জাহাঙ্গীরের জীবনে ঘটে যাওয়া আচমকা ঘটনা তাঁকে আমূল বদলে দেয়। আর সে ঘটনা বড় পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক তানিম নূর। জীবনের প্রথম সিনেমার জন্য তিনি অনুপ্রেরণা নিয়েছেন ১৮১ বছর আগের ব্রিটিশ সিনেমা ‘আ ক্রিসমাস ক্যারল’–এর। ভিনদেশি সিনেমার গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হলেও এটাকে আধুনিক বাংলা সিনেমাই মনে হয়েছে। আর এজন্য পরিচালকের পাশাপাশি চিত্রনাট্যকার আয়মান আসিব স্বাধীন ও সামিউল ভুঁইয়া বড় কৃতিত্ব পেতেই পারেন।
মিরাকলের মতো জাহাঙ্গীরের বদলে যাওয়াটা ভৌতিক আবহে দেখিয়েছেন পরিচালক। এক রাতে জাহাঙ্গীরের বাসায় তারিক আনাম খানের বেশে হাজির হয় ভূত। পরবর্তীতে সেই একই ভূত ধারণ করে চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান ও অপি করিমের বেশ। তবে ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং বিশেষ ক্ষমতাবলে জাহাঙ্গীরের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তাঁর সামনে তুলে ধরে।
আর সেটার উপস্থাপন এমনভাবে হয়েছে- অজান্তেই হাসি চলে আসবে দর্শকের মুখে। জাহাঙ্গীরের যাপিত জীবনের মন খারাপের দৃশ্য মুহূর্তেই আবেগি করে তুলবে। আবার চোখের কোণে জল হাজির হওয়ার আগেই ভাসাবে হাসির জগতে!
নিজের জীবনের উত্থান-পতন দেখতে দেখতে জাহাঙ্গীরের যেমন ভুল ভাঙবে, তেমনি দর্শকদের মনোজগতেও বড় ধাক্কা দেবে!
এই সিনেমায় সম্পর্কের গভীরতা, মমত্ববোধের মতো বিষয়গুলো দারুণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জোর করে কিংবা সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর দৃশ্য নেই। কাউকে অযাচিতভাবে বড় করার তাড়না নেই। আছে জীবনকে নতুনভাবে দেখার বার্তা। আছে শক্তিশালী ও মনে রাখার মতো সংলাপও।
‘কোনো কিছু একা এনজয় (উপভোগ) করতে চাইলে কাউকে সাথে আনবেন না। আর কাউকে সাথে আনলে তাকে একা করে দেবেন না।’
কিংবা ‘ওড়ার জন্য শুধু ডানা লাগে না, খোলা আকাশটাও লাগে।’
ভূত চঞ্চল-অপি আর জয়াকে দিয়ে জাহাঙ্গীরের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর এ সাধারণ গল্প তীব্র গরমে শীতল পরশ বইয়ে দেওয়ার মতো প্রশান্তি দেবে। জাহাঙ্গীর চরিত্রে জাহিদ হাসান এতটাই দুর্দান্ত ও অনবদ্য ছিলেন যে, তাঁকে জাহিদ হাসান নয়, বরং পাশের বাসার কোনো বিরক্তিকর চরিত্রই মনে হয়েছে। জাহাঙ্গীরের অতীত জীবনে ছোট বেলার চরিত্রে সৌম্য জ্যোতি ছিলেন ‘পারফেক্ট’ কাস্টিং। তাঁর প্রেমিকা চরিত্রে সাদিয়া আয়মানকে ভীষণ মিষ্টি লেগেছে। দুর্বলতা বলতে, রেগে যাওয়ার মুহূর্তে দুজনেরই ডায়ালগ ডেলিভারিতে উন্নতির জায়গা আছে।
চঞ্চল চৌধুরীর শুরুর দিকের অভিনয় আরোপিত মনে হচ্ছিল। সময় গড়ানোর সঙ্গে সেটা ঠিক হয়েছে। জয়া আহসানের ডায়লগ ডেলিভারি শুরুর দিকে স্বাভাবিকতার বৃত্ত ভাঙলেও, সময়ের সাথে সাথে তা পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে অপি করিম, আফসানা মিমি, তারিক আনাম খান, ইন্তেখাব দিনার কিংবা সুনেরা ছিলেন নিজ নিজ চরিত্রে বেশি সাবলীল।
এত এত বড় কাস্টিং দারুণভাবেই সামলেছেন তানিম নূর। সিনেমার একটা ডায়লগেই সেটা ব্যাখ্যা করা যায়, ‘জীবন নামের সিনেমায় মেইন ক্যারেক্টার বলে কিছু নাই, সবাই সবার সাপোর্টিং ক্যারেক্টার।’
শুধু ক্যারেক্টার নয়, সিনেমাটোগ্রাফি, সেট ডিজাইন, আলোকসজ্জাসহ অন্যান্য বিষয়গুলোও ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। জাহাঙ্গীরের অতীত দেখাতে গিয়ে নব্বই দশকের আবহটা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। ‘তুমি’ ও ‘ধূসর সময়’ নামের দুটি গান আছে সিনেমায়, সেটা এককথায় গল্পের সঙ্গে মিশে গেছে।
সিনেমার পর্দায় বিরতির সময়টা হুট করেই আসে। কোনো চমকে যাওয়া দৃশ্য বা বাড়তি আগ্রহের জন্ম দিয়ে বিরতিতে গেলে আরেকটু উপভোগ্য হতো হয়তো। পূর্ণ্যদৈর্ঘ্য সিনেমা হিসেবে ১১২ মিনিটও কিছুটা কম বোধ হয়েছে। এক অর্থে, উৎসবের আমেজ অবশ্যই দিয়েছে ‘উৎসব’। জাহাঙ্গীরের যাপিত জীবনের দিনলিপির সঙ্গে যাত্রা করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেই বের হওয়া গেছে সিনেমা হল থেকে।
রেটিং: ৪.২৫ / ৫.০০
পরিচালক: তানিম নূর
চিত্রনাট্য: আয়মান আসিব স্বাধীন ও সামিউল ভুঁইয়া
অভিনয়শিল্পী: জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, অপি করিম, চঞ্চল চৌধুরী, আফসানা মিমি, তারিক আনাম খান, ইন্তেখাব দিনার, সুনেরাহ বিনতে কামাল, আজাদ আবুল কালাম, সৌম্য জ্যোতি, সাদিয়া আয়মান প্রমুখ
ধরন: কমেডি, ড্রামা
ভাষা: বাংলা
মুক্তি: ৭ জুন ২০২৫