একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাডারে। লাইব্রেরিতে একমনে গুছিয়ে যাচ্ছে বই। গোছানোর সময় আর কোনোদিকে তাকাচ্ছে না সে। এতই মনযোগ বই গোছানোয়! অথচ তার মা তখন হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। শেষে মামা ধরলেন ভাগ্নের হাত। মানসিক সমস্যায় ভোগা ছেলেটির নতুন জীবন শুরু হলো বোনদের সঙ্গে। আর সেই জীবনের পরতে পরতে মিশে গেল রহস্য!
এমনই এক গল্প দিয়ে শুরু হয় ‘আইডেনটিটি’। ভারতের মালায়লম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এরই মধ্যে অ্যাকশন-থ্রিলার জনরা দিয়ে সিনেমাপ্রেমীদের মাত করে ফেলেছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও হয় তেমনি ঘরানার একটি সিনেমা দিয়ে। হ্যাঁ, সেটিই আইডেনটিটি। আর বছরের শুরুতেই এই ছবিতে চমকে দিয়েছে মলিউড। কৌশলী গল্প ও দুর্দান্ত অ্যাকশনকে এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছে যে, বলতেই হয়—কম বাজেটের এই সিনেমা হলিউডের অনেক ছবিকেও হার মানায়!
আইডেনটিটি পরিচালনা করেছেন অখিল পল ও আনাস খান। গল্পও লিখেছেন এই দুজনই। ফলে সবচেয়ে ভালো যে কাজটি হয়েছে, সেটি হলো চিত্রনাট্যের পথের সঙ্গে পর্দার সিনেমার বৈসাদৃশ্য প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকটা সচেতনভাবেই কিছু বিচ্যুতি বেশ সুন্দরভাবে সামলে ফেলা গেছে। প্রায় ১৫৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমাটি দেখতে গিয়ে কখনোই তাই ক্লান্তবোধ হয় না। বরং আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করার সমস্ত উপাদানই আছে এই সিনেমায়।
বাচ্চা ছেলেটির যে প্রসঙ্গ সিনেমার শুরুতেই দেখানো হয়, গল্পের পরের পরতে কিন্তু তার উল্লেখ থাকে না। বরং যেন এক নতুন গল্প শুরু হয়। চলে আসে গোপনে নারীদের ভিডিওচিত্র ধারণ করার মতো অপরাধ এবং তা দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার বিষয়গুলো। আর তখনই দেখা যায়, সেই বাচ্চা ছেলেটির অন্য রূপ। জানা যায়, তার নামই হরণ শঙ্কর। পরিচয় দেখানো হয় কারাতে ইনস্ট্রাকটর হিসেবে। চলন-বলনে থাকে অস্বাভাবিকতাও। এর মধ্যেই এক পুলিশ কর্মকর্তা এক সাক্ষীকে বাঁচানোর কথা বলে প্রতিবেশী হয় হরণের পরিবারের। গল্পে আসতে থাকে নতুন নতুন সব টুইস্ট। একপর্যায়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি ওঠে, সেটি হলো— মানসিক সমস্যায় ভোগা হরণ আসলে কে?
মালায়লম সিনেমা অবশ্য এসব অপ্রত্যাশিত টুইস্টের জন্যই বিখ্যাত। অ্যাকশন-থ্রিলারে তা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘আইডেনটিটি’তেও এর অন্যথা হয়নি। তবে বেশির ভাগ টুইস্টই সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি। তাই বেখাপ্পা লাগে না। সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফি দারুণ। আবহসংগীতের ব্যবহারও খাপে খাপ। ছবিটির প্রায় অর্ধেক সীমা পর্যন্ত সেভাবে অ্যাকশন দৃশ্য দেখা না গেলেও, এরপর একে একে হাজির হতে থাকে। তখন গল্পের প্যাঁচ খুলে যায় অনেকটাই। সবচেয়ে বড় কথা, সেসব অ্যাকশন দৃশ্যগুলো বেশ বাস্তবানুগ। দেখতে ভালো লাগে। বিশেষ করে একেবারে শেষের দিকে উড়োজাহাজের ভেতর যে অ্যাকশন দৃশ্যের মাধ্যমে গল্প যবনিকা পতনের দিকে এগিয়ে যায়, সেটি দেখার পর হলিউডের মারকাটারি মুভির সাথে খুব বেশি অমিল পাওয়া যায় না।
সিনেমাটির সবচেয়ে বড় সম্পদ এর গল্প। এর পরেই থাকবে অভিনয়শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয়। হরণ শঙ্করের চরিত্রে থাকা টোভিনো থমাসের অভিনয় ছিল অত্যন্ত ক্ষুরধার। গল্পের প্রয়োজনের এই চরিত্রটির রূপ বদল হয়েছে বারবার। আর প্রত্যেকবারই নিজেকে দারুণভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন টোভিনো থমাস। এক মুহূর্তের জন্যই দর্শকদের সন্দিহান হওয়ার সুযোগ দেননি তিনি। খলচরিত্রে বিনয় রাই একেবারে যোগ্য প্রতিযোগী ছিলেন থমাসের। স্ক্রিনে পাল্লা দিয়েছেন সমানে সমান। সেদিক থেকে ত্রিশা কৃষ্ণান সুযোগ কিছুটা কমই পেয়েছেন বলা চলে।
অথচ মলিউডের এই ছবির বাজেট মোটে ১২ কোটি রুপি। এই বাজেটে যে এত সুগঠিত একটি সিনেমা বানানো যায়, সেটি সত্যিই বিস্ময়কর। আর এই জায়গাতেই বলিউড তো বটেই, হলিউডের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিয়ে লড়েছে মলিউডের এ সিনেমা। গত জানুয়ারির একদম শুরুতে আইডেনটিটি মুক্তি পেয়েছিল সিনেমা হলগুলোয়। মোটামুটি মানের ব্যবসা করতে পেরেছে। তবে ব্যবসার তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ছবি নিয়ে আলোচনা বেশি। এরই মধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি ফাইভে এটি মুক্তি পেয়েছে।
অবসরের সময়টাকে উপভোগ করতে তাই দেখতেই পারেন ‘আইডেনটিটি’। সময়টা কাটবে ভালোই।