ইংরেজিতে বলে উইচ, বাংলায় ডাইনি। আরও নানা ভাষাতেও নিশ্চিতভাবেই এই শব্দটির উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ আছে। থাকতেই হবে। কারণ সব ভাষাতেই এই শব্দটিকে ভয়ঙ্কর রূপ দেওয়ার বা ভীতি উৎপাদনকারী বানানোর উদ্দেশ্য একই। আর তার গভীরে ঢুকলেই বেরিয়ে আসে আরও অন্ধকার। অন্যায় ও রক্তের যুগলবন্দী মেলে সেখানে।
ঠিক সেই অন্ধকার দিকটিই তুলে আনার চেষ্টা করেছে ‘ডাইনি’। সম্প্রতি এই সিরিজটি মুক্তি দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই। প্রথম সিজনে ৬টি পর্বে বলা হয়েছে এক ডাইনি’র গল্প। সিরিজের পরিচালক নির্ঝর মিত্র। ওটিটি প্ল্যাটফর্মটি বলছে, ‘ডাইনি’ একটি সারভাইভাল ড্রামা।
সিরিজের গল্প সম্পর্কে হইচই বলেছে, ‘পাতা বহু বছর পর দেশে ফেরে তার সদ্য মৃত বাবার উত্তরাধিকার দলিল অনুযায়ী সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে। সেই সূত্রেই পাতা তার বোন লতার প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে আবিষ্কার করে যে গ্রামবাসীরা লতাকে ডাইনি চিহ্নিত করে পুড়িয়ে মারতে প্রস্তুত। লতাকে বাঁচাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাতা এই নির্মম গ্রাম এবং নিষ্ঠুর ডাইনিপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।’ এটুকু থেকেই বুঝে ফেলা যায় যে, লতাকে বাঁচাতে পাতার যে মিশন, তা নিয়েই মূলত এগিয়েছে সিরিজটির গল্প। এক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে নন–লিনিয়ার ভঙ্গি। ফলে বর্তমানের ফাঁকে ফাঁকে অতীত দেখতে দেখতেই জানা হতে থাকে লতা–পাতার সব কাহিনি।
সারভাইভালের ড্রামায় বেশ দ্রুতই ঢুকে যায় ‘ডাইনি’। প্রথম পর্ব থেকেই। ফলে দর্শকদের অ্যাড্রেনালিন রাশের জন্য খুব একটা অপেক্ষা করতে হয় না। এর পরবর্তী পর্বগুলোয় তারই জের টানা হয়। ফাঁকে ফাঁকে আসতে থাকে লতা–পাতার আগের জীবনের টুকরো গল্প। ভারতের উত্তরবঙ্গের খুনিয়াবাড়ি নামের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা লতাকে উদ্ধার করে আনা হয় স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানেও জড়ো হয় মব। এরপর চলে মবের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই।
এই গল্প কিন্তু একেবারে আকাশ থেকে পড়া কোনো কাহিনি নয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও ডাইনি অপবাদ দিয়ে নারীদের হত্যার ঘটনা পাওয়া যায়। খবর আসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও। সাম্প্রতিককালেও এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে ভারতে। এবং এই প্রক্রিয়ায় যেভাবে নারীদের হত্যা করা হয়, তা খুবই নিষ্ঠুর। এই বিষয়টিকেই মূলত তুলে ধরার চেষ্টা করেছে ‘ডাইনি’।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই সিরিজে নিষ্ঠুরতা ও ক্রূরতাকে ভিজ্যুয়ালি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে কিছুটা মাত্রাতিরিক্তই হয়ে গেছে বলা চলে। তাই কখনও কখনও ব্যাপারটা অহেতুকও মনে হতে পারে দর্শকদের। কারণ নিষ্ঠুরতার আবহ নানাভাবেই তৈরি করা যায়। সব সময়েই যে রক্ত ছিটিয়েই তা করতে হবে, সেটি নয়। তবে ‘ডাইনি’র পরিচালক কেবল সেই পথে হাঁটতে গিয়েই কিছুটা তালগোল পাকিয়েছেন।
আবার, ১ থেকে ৪ পর্ব পর্যন্ত যেভাবে গল্প এগোয়, ৫ ও ৬তম পর্বে গিয়ে তাতে একটা তাড়াহুড়ো পরিলক্ষিত হয়। এতে করে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে শেষ দুটি পর্ব। পাতার প্রতিরোধকে অ্যাকশন দৃশ্যের মাধ্যমে বড় করে দেখানোর চেষ্টা থাকলেও, তাতে খুব একটা সফলতা মেলেনি। আবার শেষটায় যেভাবে ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলল, সেটিও কেন জানি আরোপিত লাগে। বরং সিরিজের ক্লাইম্যাক্স আরও আকর্ষণীয় ও মনে রাখার যোগ্য হিসেবে নির্মাণের সুযোগ ছিল। কিন্তু চেনা রাস্তায় হাঁটতে গিয়েই সব হয়ে পড়ে ক্লিশে।
‘ডাইনি’ সিরিজে অভিনয়ে আছেন মিমি চক্রবর্তী, কৌশানি মুখার্জী, সুদীপ মুখার্জী, বিশ্বজিৎ দাস, অরিন্দল বাগচী, সুজিত কুমার বর্মন, সায়ক রায়, শ্রুতি দাস প্রমুখ। মিমি ছিলেন পাতা নামের চরিত্রে। একেবারে নিখুঁত বাছাই বলা চলে। তবে এই সুঅভিনেত্রীকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল। লতার ভূমিকায় থাকা কৌশানিও স্পেস পাননি খুব একটা। তবে চমকে দিয়েছেন মূল খলনায়কের ভূমিকায় থাকা বিশ্বজিৎ দাস। এই অভিনেতার শরীরী ভাষা থেকে ডায়লগ থ্রোয়িং—সবই ছিল দুর্দান্ত।
এক কথায়, ‘ডাইনি’ সিরিজে স্পষ্টভাবেই একটি সামাজিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। এবং সেই অনুযায়ীই তৈরি হয়েছে গল্প। অন্তত আমি–তুমি বা গোয়েন্দা থ্রিলারের চিরচেনা ওটিটি বৃত্তের বাইরে বের হয়ে একটি ভিন্ন ধারার গল্প দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। এর জন্য নির্মাতা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
হাতে সময় থাকলে দেখে ফেলাই যায় ‘ডাইনি’। একবিংশ শতকে এসেও নিখাদ পিতৃতন্ত্র স্বার্থবন্দী হয়ে কীভাবে নারীদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে স্রেফ মেরে ফেলতে চাইছে, তার এক নিষ্ঠুর চিত্রায়ণ চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠবে। জোগাবে ভাবনার নতুন খোরাকও!