স্থূলতা হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা, যা অতিরিক্ত ওজন বা অত্যধিক চর্বি জমে তৈরি হয়। স্থূলতা একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ক্রমশ বেড়ে চলেছে, আর বাংলাদেশও এই সংকট থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্থূলতা একটি জটিল রোগ যা অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্ট হয় এবং এটি হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ নানা গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রতি বছর ৪ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব স্থূলতা দিবস। বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে স্থূলতার ক্ষতি এবং প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এই দিবসের লক্ষ্য।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (BDHS) এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৪ শতাংশ নারী এবং ১৮ শতাংশ পুরুষ স্থূলতার শিকার। শহরাঞ্চলে ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং অপরিকল্পিত জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও তীব্র করছে। শিশুদের মধ্যেও স্থূলতার হার বেড়ে যাওয়া ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
স্থূলতা একাধিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
হৃদ্রোগ: অতিরিক্ত চর্বি রক্তনালীতে জমে উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিস: টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা স্থূলদের মধ্যে অনেক বেশি।
ক্যানসার: ব্রেস্ট, কোলন এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়।
মানসিক সমস্যা: স্থূলতার কারণে বিষণ্নতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা হতে পারে।
অর্থনৈতিক চাপ: স্থূলতা এবং এর সংশ্লিষ্ট রোগগুলোর চিকিৎসায় ব্যয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে স্থূলতার প্রধান কারণগুলো হলো:
খাদ্যাভ্যাস: উচ্চ-ক্যালোরি এবং ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি।
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব: প্রযুক্তির ব্যবহার শারীরিক কার্যক্রম কমিয়ে দিয়েছে।
জেনেটিক কারণ: পরিবারে স্থূলতার ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বেশি।
অপরিকল্পিত জীবনযাপন এবং মানসিক চাপ: ঘুমের অভাব এবং মানসিক চাপ স্থূলতা বাড়াতে সহায়ক। মানসিক চাপের ফলে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং শরীরে চর্বি সঞ্চয়কে ত্বরান্বিত করে, ফলে স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে।
স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে কিছু কার্যকর উপায় হলো:
সুষম খাদ্যাভ্যাস: কম চর্বি ও কম চিনিযুক্ত খাবার এবং প্রচুর শাকসবজি খাওয়া জরুরি।
নিয়মিত ব্যায়াম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা শারীরিক পরিশ্রম সহায়ক।
পর্যাপ্ত ঘুম: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন: স্ট্রেস কমাতে মেডিটেশন বা যোগ ব্যায়াম করা যেতে পারে।
জনসচেতনতা: স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিয়ে প্রচার কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন।
স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রের উদ্যোগও অপরিহার্য। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা এই সমস্যা মোকাবিলা করতে পারি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও সক্ষম সমাজ উপহার দিতে আমাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: পুষ্টিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ