কিডনি রোগের সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা জড়িত। যেমন: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ। আমাদের সবারই কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। কিছু লক্ষণ কিডনি রোগের সংকেত বহন করে। এগুলো হলো:
১. মুখ, চোখ যদি হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে, তাহলে অবশ্যই সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ, কিডনির সমস্যার ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে।
২. বারবার প্রস্রাবের বেগ অনুভব করলে সে ক্ষেত্রে আগে থেকেই সাবধান হওয়া প্রয়োজন। কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে এমন সমস্যা দেখা দেয়।
৩. যদি দেখেন আপনার হাত, পা বা পিঠের পেশিতে ঘনঘন অস্বাভাবিক টান বা খিঁচুনি ধরছে তাহলে অবশ্যই সতর্ক হওয়া জরুরি। কিডনির সমস্যা বা অসুখের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে।
৪. কিডনির সমস্যার কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। কারণ, কিডনি আমাদের শরীরের ক্ষতিকর পদার্থগুলো শরীর থেকে ছেঁকে বের করে দেয়। তাই কিডনি বিকল হয়ে পড়লে শরীরে এই ক্ষতিকর পদার্থগুলো জমে গিয়ে আমাদের ত্বক কে শুষ্ক ও রুক্ষ করে দেয়।
৫. গোড়ালি বা পায়ের পাতা হঠাৎই অস্বাভাবিক ফুলে গেলে এটিও কিডনি সমস্যার আরেকটি উপসর্গ হতে পারে।
৬. কিডনির সমস্যা থাকলে একাধিকবার মূত্রথলিতে সংক্রমণ হতে পারে। এ ছাড়াও প্রস্রাবের সময় জ্বালা বা ব্যথাও করতে পারে।
৭. পিঠের দিকে, কোমরের একটু উপরে যদি ঘনঘন ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে অবশ্যই সতর্ক হওয়া জরুরি। কিডনি ঠিকভাবে কাজ না করলে অনেক ক্ষেত্রে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত চলে আসতে পারে।
৮. কিডনির সমস্যায় ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্ত ভালোভাবে পরিশুদ্ধ হতে পারে না। তাই ঘুমের ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৯. রক্তচাপের দ্রুত ওঠানামা, অল্প পরিশ্রমেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা, শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট হওয়ার পেছনেও লুকিয়ে থাকতে পারে কিডনির সমস্যা।
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে কী খাওয়া যাবে আর কী যাবে না-
দীর্ঘমেয়াদি কিডনি সমস্যা বা কিডনি অকার্যকর হওয়ার প্রধানতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। এ ছাড়া যাঁরা অনেক দিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যথার ওষুধ খাচ্ছেন, যাঁদের অটোইমিউন রোগ (শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সুস্থ অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে) আছে, তাঁদের কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কারও কিডনির কার্যকারিতা তিন মাসের বেশি সময় ধরে কম বা ক্রমাগত কমে যেতে থাকলে তাকে বলে দীর্ঘমেয়াদি কিডনি সমস্যা (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ)। এ অবস্থায় কী কী খাবার খাওয়া যাবে এবং কী খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে।
কিডনি সমস্যা ধরা পড়ার পর অনেকেই প্রোটিন বা আমিষ–জাতীয় খাবার খাওয়া একদম কমিয়ে দেন। গবেষণায় দেখা গেছে, আমিষ–জাতীয় খাবার অত্যধিক কমিয়ে দিলে পুষ্টিহীনতা হয়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। কিডনির কার্যক্ষমতা বুঝে প্রোটিন গ্রহণের মাত্রা ঠিক করা উচিত।
কিডনির কার্যক্ষমতা কতটুকু আছে, রক্তের পরীক্ষা দিয়ে নির্ণয় করা যায়। কিডনির সমস্যা মৃদু হলে স্বাভাবিক খাবার খেতে বাধা নেই। যদি eGFR< 60 হয়, তাহলে আমিষ বা প্রোটিন দিনে ০.৮/কেজি ওজন খেতে হবে। এর মানে ৬০ কেজি ওজনের একজন রোগী দিনে ৪৮ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারবেন। তবে মনে রাখতে হবে, এই মাত্রা তৈরি হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের জন্য, কারণ তাদের খাবারে মাংসের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভাসে মাছ বা মাংসের পরিমাণ এমনিতেই তুলনামূলক কম। কিডনির সমস্যা থাকলেও দিনে ১টা ডিম, দুপুর ও রাতের খাবারে ২ টুকরা মাছ বা মাংস, ৩ বা ৪ টেবিল চামচ ডাল খেতে বাধা নেই। তবে রেড মিট মানে গরু বা খাসির মাংসের পরিবর্তে মুরগির মাংস ও মাছ খাওয়া ভালো।
কিডনি রোগীদের সব সময় যে নানা ধরনের ফল বা শাকসবজি খাওয়া নিষেধ, এ ধারণা ঠিক নয়। শুধু কারও রক্তে যদি পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে বা কিডনির জিএফআর যদি ৩০–এর কম হয়, তাহলে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খেতে হবে। ডাবের পানি, কলা, খেজুর, শুকনা ফল, আলু, টমেটো, শসা, পালংশাক, ফলের রসে পটাশিয়াম বেশি থাকে।
আপেল, পেয়ারা, আঙুর, নাশপাতি, জাম, তরমুজ—এ ফলগুলোয় পটাশিয়াম তুলনামূলক কম থাকে। এ ফলগুলো পরিমাণমতো খাওয়া যাবে। শাকসবজি সেদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে তারপর রান্না করতে হবে। খাবারে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। কিডনির জিএফআর ৬০–এর কম হলে দিনে ১০০০ গ্রামের বেশি ক্যালসিয়াম না খাওয়া ভালো। ছয় মাস অন্তর রক্তে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি–এর মাত্রা পরীক্ষা করে প্রয়োজন হলে খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, পরিচালক, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, চট্টগ্রাম