মানুষের সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সম্মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু সম্পর্কে এই উপাদানগুলো ক্রমেই ক্ষয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে যখন একপক্ষের মধ্যে থাকে অতিরিক্ত আত্মমুগ্ধতা বা নার্সিসিস্টিক বৈশিষ্ট্য।
নার্সিসিজম (Narcissism) শব্দটি এসেছে গ্রিক পুরাণের ‘নারসিসাস’ নামক চরিত্র থেকে। যে নিজেই নিজের প্রতিচ্ছবির প্রেমে পড়ে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানে, নার্সিসিজম হলো এমন এক ধরনের ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে সবসময় অন্যের থেকে বড়, অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসাযোগ্য মনে করেন। তারা নিজের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেন এবং অন্যের অনুভূতির প্রতি থাকে তীব্র উদাসীনতা।
নার্সিসিস্টিক বৈশিষ্ট্যে একটি মাত্রা থাকে, যেখানে কেউ হালকাভাবে এই গুণে আক্রান্ত হন, আবার কারো ক্ষেত্রে এটি ব্যক্তিত্ব বিশৃঙ্খলা (Narcissistic Personality Disorder - NPD) রূপে দেখা যায়।
লক্ষণ:
- সবসময় প্রশংসা ও মনোযোগ দাবি করে।
- নিজের ভুল কখনও স্বীকার করে না।
- অন্যকে দোষারোপ করে।
- সহানুভূতি প্রকাশে অক্ষম।
- নিজের চাহিদাকে সবসময় অগ্রাধিকার দেয়।
- সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে নার্সিসিজমের প্রভাব
নার্সিসিস্টিক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের শুরুতে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে। তারা আত্মবিশ্বাসী, এবং কথায়-কাজে মোহ তৈরি করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সম্পর্ক রূপ নেয় এক ধরনের মানসিক শোষণে।
১. গ্যাসলাইটিং ও আত্মসন্দেহ:
নার্সিসিস্টিক ব্যক্তিরা প্রিয়জনকে ‘গ্যাসলাইটিং’ করে। মানে এমনভাবে প্রশ্ন তোলে যে, সঙ্গী নিজের অনুভূতি, সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতা নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়ে। এই আচরণ ধীরে ধীরে একজন ব্যক্তির আত্মসম্মান ধ্বংস করে দেয়।
২. সহানুভূতির অভাব:
যখন আপনি কষ্টে থাকেন, নার্সিসিস্টিক সঙ্গী আপনার পাশে না থেকে নিজের সমস্যাকে বড় করে তোলেন। এমন সময়েও আপনি যেন একা অনুভব করেন।
৩. সম্পর্কে একতরফা প্রচেষ্টা:
এই সম্পর্কগুলোতে সাধারণত একপক্ষ সব দেয়, আর অন্যপক্ষ শুধু নেয়। প্রেম, শ্রদ্ধা বা সহানুভূতির কোনো ভারসাম্য থাকে না।
আপনি কী করতে পারেন?
এমন সম্পর্কে থাকা মানে ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের আলো নিভিয়ে ফেলা। তবে এই চক্র ভাঙা সম্ভব। যদি আপনি সচেতন হন, নিজেকে মূল্য দেন এবং সাহায্য নিতে প্রস্তুত থাকেন। যেমন–
- নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করুন।
- ‘না’ বলতে শিখুন।
- নিজের সীমারেখা নির্ধারণ করুন।
- বিশ্বস্ত কারো সঙ্গে কথা বলুন।
- প্রয়োজন হলে থেরাপিস্ট বা কাউন্সেলরের সহায়তা নিন।
থেরাপির ভূমিকা
নার্সিসিস্টিক সম্পর্ক থেকে সেরে ওঠা সহজ নয়। অনেক সময় সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পরও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে সময় লাগে। থেরাপি আপনাকে সেই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে। এটি আরও সাহায্য করে–
- আত্মপরিচয় ফিরে পেতে।
- মানসিক ট্রমা থেকে দূরে থাকতে।
- ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
নার্সিসিজম কোনো সাধারণ ব্যক্তিত্ব বৈশিষ্ট্য নয়। এটি সম্পর্ককে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে ক্ষয় করে। তাই সচেতন থাকা, নিজেকে ভালোবাসা এবং প্রয়োজনমতো সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখবেন আপনি সম্মান পাওয়ার যোগ্য, ভালোবাসারও।
নীলু ও তানভীরের সম্পর্ক
নীলু সহানুভূতিশীল, দয়ালু। সম্পর্কের শুরুতে তানভীর ছিল খুবই রোমান্টিক, প্রশংসাপূর্ণ ও আত্মবিশ্বাসী। সে প্রায়ই বলত, ‘তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ’, ‘তুমি আমার জীবনের আলো।’
প্রথম ছয় মাস ছিল যেন এক রূপকথার গল্প। তবে এরপর ধীরে ধীরে তানভীরের আচরণ বদলাতে শুরু করে। তানভীর নীলুকে তার বন্ধুমহল, পরিবার, এমনকি পছন্দের পোশাক বা কাজ নিয়েও সমালোচনা করতে থাকে। তানভীর বলে, ‘তোমার বন্ধুরা তোমার পেছনে হাসে, বুঝলে?’,‘তুমি কীভাবে এমন বাজে রঙের কাপড় পরো?
আবার যখন নীলু নিজের অনুভূতি প্রকাশ করত, তানভীর বলে, ‘তুমি সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করো।’, ‘সবসময় তুমি দোষ খোঁজো আমার মাঝে।’
সে প্রায়ই এমনভাবে কথা বলত যে নীলু নিজের বুদ্ধি বা স্মৃতিশক্তি নিয়েই সন্দেহ করতে শুরু করত। — একে বলে গ্যাসলাইটিং।
তানভীর কখনো নিজের ভুল স্বীকার করত না, বরং বলে, ‘তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসতে, তাহলে এসব নিয়ে অভিযোগ করতে না।’
ধীরে ধীরে, নীলু একা হয়ে পড়ে। তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে, বন্ধুমহল থেকে দূরে সরে যায়। নিজেকে ‘খারাপ সঙ্গী’ মনে হতে থাকে।
এই সম্পর্কের মাঝে রয়েছে নার্সিসিস্টিক আচরণের কয়েকটি স্পষ্ট লক্ষণ। যেমন–
১. আত্মমুগ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা।
২. সহানুভূতির অভাব।
৩. গ্যাসলাইটিং।
৪. অন্যকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলা।
নীলু যখন কাউন্সেলিংয়ে আসেন, তখন তিনি ভাবেন, ‘সমস্যা বোধহয় আমারই, আমি কেন সব সময় কষ্ট পাই?’ থেরাপির মাধ্যমে তিনি বুঝতে শেখেন, এটি তার দোষ নয়, এটি ছিল এক ধরনের মানসিক শোষণ।
তিনি ধীরে ধীরে নিজের সীমারেখা তৈরি করতে শেখেন, আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার করেন এবং সম্পর্ক থেকে বের হয়ে নতুন জীবনের পথে হাঁটেন।
এই গল্পটি বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন হলেও, নাম ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করা হয়েছে সচেতনতার উদ্দেশ্যে।
লেখক: সাইকোলজিস্ট, শান্তিবাড়ী