একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ফয়সাল মাহমুদ (ছদ্মনাম)। প্রতি মাসে ১০টিরও বেশি প্রকল্প চলে তাঁর বিভাগে। কাজের চাপ তাই স্বভাবতই থাকে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি থাকে জরুরি কাজ জরুরি ভিত্তিতে শেষ করার মানসিক চাপ। এক্ষেত্রে সব কাজই যে প্রকৃতপক্ষেই জরুরি থাকে, বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু ফয়সালের বস সেভাবেই কাজ করেন এবং নির্দেশনা দেন। ফলে যে কাজ জরুরি ভিত্তিতে করার দরকার নেই ততটা, সেটিও নাকে–মুখে করতে হয় ফয়সালদের!
অফিসের পোশাকি ভাষায় এই সংকটকেই বলা হয় ‘ফলস আরজেন্সি’। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এটি হচ্ছে অফিসে কৃত্রিমভাবে তৈরি জরুরি অবস্থা। অর্থাৎ, অফিস বা অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এমন একটি পরিবেশ সতীর্থ কর্মীদের জন্য তৈরি করেন, যেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শেষ করার তাড়া দেওয়া হয়। তবে সেটি পুরোপুরি ‘কপট’ বা যার আসলে কোনো ভিত্তিই নেই। যেমনটা হয় ফয়সালের অফিসে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অফিসে মাঝে মাঝে ঊর্ধ্বতনেরা এমন প্রকল্পের কাজও প্রচণ্ড তাড়া দিয়ে আগেভাগে করিয়ে নেন, যা শেষ করার সত্যিকারের তারিখ আসলে আরও কয়েক সপ্তাহ পর!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানের করপোরেট সংস্কৃতিতে বিশ্বজুড়েই বাড়ছে ফলস আরজেন্সির প্রকোপ। সংক্রামক ব্যাধির মতোই এটি ছড়িয়ে পড়ছে এক অফিস থেকে অন্য অফিসে। এর ফলে যখন সব কাজই জরুরি হয়ে যায়, তখন সৃজনশীল ও গভীর কাজ করার সুযোগ কমে যেতে থাকে। কারণ, সৃজনশীল কাজের জন্য স্বভাবতই একটু বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফলস আরজেন্সিতে সেই সুযোগই আসে না। এতে করে কর্মীদের বেশির ভাগ কাজই হয় ভাসা ভাসা ও ভঙ্গুর প্রকৃতির। একটু কড়া নজরে পরীক্ষা করতে গেলেই সেসব কাজের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ফলস আরজেন্সি আসলে কাদের সৃষ্ট? উত্তরে বলা যায়, কখনো কখনো পুরো প্রতিষ্ঠানই এমন সংস্কৃতি তৈরি করে। আবার কখনো একটি প্রতিষ্ঠানের গুটিকতক বিভাগের কয়েকজন নেতা এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে বিবেচিত হন। মূলত এই বিষয়টি ব্যক্তি থেকেই উৎসারিত হয়, পরে তা পুরো বিভাগে বা পুরো প্রতিষ্ঠানেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এমন সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বড় যে প্রভাবটি পড়ে, সেটি হলো—একটি নির্দিষ্ট বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা একপর্যায়ে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। অহেতুকভাবে ক্রমাগত ‘জরুরি নয়’ এমন কাজও জরুরি ভিত্তিতে করতে করতে তাদের কাজের প্রতি উৎসাহই কমে যায়। তখন সব কাজই গড়পড়তা মানের হয়। এমনকি সত্যিকারের জরুরি কাজটিও পাত্তা পায় না কর্মীদের কাছে। সেটিতেও আর বাড়তি মনযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। এতে করে দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিষ্ঠানই। এমনকি প্রতিষ্ঠানের আয়ও কমে যেতে পারে ব্যাপক হারে।
এ কারণে বিশ্লেষকেরা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের ‘ঠিক’ করার প্রতি জোর দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, সব নেতাই ইচ্ছা করে ‘ফলস আরজেন্সি’ সৃষ্টি করেন না। অনেক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবেও এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। কখনো কখনো বড় কর্তারা বুঝতেই পারেন না যে, তারা সব কাজেই সহকর্মীদের তাড়া দিচ্ছেন! তাই এমন পরিস্থিতির লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে ব্রতী হওয়া প্রয়োজন।
আসুন, এবার জেনে নেওয়া যাক ‘ফলস আরজেন্সি’র মতো পরিস্থিতিতে কী কী করা প্রয়োজন। এসব পদক্ষেপে পরিস্থিতির উন্নতি আনা খুবই সম্ভব।
প্রথমত, ফলস আরজেন্সির লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। আসলেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত হতে হবে। এর জন্য নিজেকে কিছু প্রশ্নও করতে পারেন। যেমন: আপনি ও আপনার টিম কি সব সময়ই কাজে ডুবে থাকেন এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে থাকেন? সহকর্মীদের মধ্যে বারবার জরুরি কাজের ঘোষণা দেওয়ার সময় আপনি কি দুঃখপ্রকাশ করেন? আপনি ও আপনার টিম কি ছুটির দিনে সত্যিকারের জরুরি কাজ করতে বসেন? অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার পরামর্শ কি আপনি প্রায়শই ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে পান? যদিও এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে বুঝতে হবে দলের নেতা হিসেবে আপনি নিজের অজান্তেই ফলস আরজেন্সির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন।
দ্বিতীয়ত, জরুরি কাজটি আসলেই কতটা জরুরি, তার উৎস চিহ্নিত করতে হবে। মূলত সফলতা পাওয়ার আশাতেই ফলস আরজেন্সি সৃষ্টি হয়। তবে কখনো কখনো এটি উদ্বেগ থেকেও হয়। তাই জরুরি যে কাজে আপনি তাড়াহুড়ো করছেন, সেটি কেন জরুরি—সেটি চিহ্নিত করতে হবে। যদি দেখেন কেবল পেশাজনিত উদ্বেগের কারণে আপনি এমনটা করছেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনি ক্রমে অনুৎপাদনশীল আচরণে বন্দী হয়ে যাচ্ছেন। এ থেকে মুক্তির জন্য অবশ্যই আপনার আচরণাবলীকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে এবং পুরো চিন্তা কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
তৃতীয়ত, কোন কাজকে অগ্রাধিকার দেবেন, আর কোনটিকে দেবেন না—সেটি নির্ধারণ করতে হবে নির্দয়ভাবে। কোনটি জরুরি, আর কোনটি গুরুত্বপূর্ণ—সেটি চিহ্নিত করতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত শুধু সময়ের দৈর্ঘ্যের হিসাব করেই অগ্রাধিকারমূলক কাজ নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ, যে কাজে সময় কম বরাদ্দ থাকে, সেটিকেই আমরা সাধারণত অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। কিন্তু সেটিই যে আদতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে, তা কিন্তু নয়। প্রকৃতপক্ষে গুরুত্ব বিচার করে অগ্রাধিকারমূলক কাজ চিহ্নিত করা উচিত। সেই সঙ্গে কয়েক দফা যেসব কাজে আপনি ও আপনার টিম সময় ও মেধা খরচ করে ফেলেছেন, কিন্তু চূড়ান্ত ফল মেলেনি—সেসব কাজে গুরুত্ব দেওয়া কমিয়ে ফেলতে হয়। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্তও নিতে হয়। ভাবতে হয় এ ধরনের কাজ করার সুবিধা ও অসুবিধা সম্পর্কেও। অর্থাৎ, কোন কাজ করা হবে এবং কোনটি করা হবে না, তা ঠিক করতে হবেই। এতে আর সব সময় তাড়া অনুভূত হবে না।
চতুর্থত, ইচ্ছে করেই কোনো কোনো কাজে গড়িমসি করা যেতে পেরে। এটি এক ধরনের কৌশল। আপনি ও আপনার টিম হয়তো দেখলেন, একটি প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি ভিত্তিতে সম্পাদন না করলেও ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেই প্রকল্পে কিছুটা গড়িমসি করা যেতেই পারে। এতে করে কাজটি কিছুটা ঝুলে গেলেও নেতা ও তার সহকর্মীরা অহেতুক তাড়াহুড়োর মধ্যে পড়বে না। আবার তখন কাজটি নিয়ে টিমের পক্ষে গভীরভাবে চিন্তা করে আরও ভালোভাবে নৈপুণ্য দেখানো সম্ভব হবে। ফলে দিনশেষে আসলে কাজটি ভালোমতোই শেষ হবে। কিন্তু অহেতুক তাড়া আর সহ্য করতে হবে না।
পঞ্চমত, কোন জরুরি কাজের অনুরোধ রাখা হবে, আর কোনটির ক্ষেত্রে ‘না’ করা হবে, সেই ব্যাপারে দলনেতা ও তার দলের কর্মীদের দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। কিছু সিদ্ধান্ত যেন সহকর্মীরাও নিতে পারেন, সেভাবে তাদের তৈরি করতে হবে। এতে করে অহেতুক ও জরুরি নয়—এমন কাজের অনুরোধকে শুরুতেই আটকে দেওয়া যাবে। তখন এটি আর বাড়তি কাজের চাপ সৃষ্টির সুযোগ পাবে না। এভাবে এক ধরনের ভেটিং প্রসেস চালু করার চেষ্টা চালাতে হবে।
ষষ্ঠত, কর্মসংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয়ভাবে করতে হবে। সব কাজ বা প্রকল্প ছোট ছোট ভাগে ভাগ না করে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একটি টু–ডু লিস্ট মেনে চলতে হবে, ক্যালেন্ডারও থাকবে একটি। এতে করে পুরো দলের সামনের চিত্রটা স্পষ্ট থাকবে।
সপ্তমত, সময় ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। সময়ের ভিত্তিতেই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। যে কাজ আজ না করলেই নয়, শুধু সেগুলোই আজকের জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। অনেক কাজের ভিড় না করে বরং এই কাজগুলোকেই সঠিক ও সুচারূভাবে শেষ করার চেষ্টা করতে হবে।
সব মিলিয়ে এটি বলতেই হয় যে, ফলস আরজেন্সির মতো পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি বা নেতাকে কৌশলী যেমন হতে হবে, তেমনি প্রয়োজনে কঠোরও হতে হবে। কোনো একটি কাজের অনুরোধ বা তাড়ার বিপরীতে আপনি প্রতিক্রিয়া দেখাতেই পারেন। তবে তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং পূর্বপ্রস্তুতি রেখে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে পারলে কমে যাবে ফলস আরজেন্সি। তখন অফিসে কাজ হবে ঠিকঠাকই, কিন্তু কাজের চাপে পিষে যাওয়ার হা–হুতাশ আর শোনা যাবে না!
তথ্যসূত্র: বিজনেস ইনসাইডার, ম্যানেজারস অ্যান্ড লিডারস ডট কম, হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, এপিএ ডট ওআরজি, ইয়াহু ফিন্যান্স ও অক্সফোর্ড একাডেমিক