ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ নিয়ে অন্তত ১৪৮টি ভুয়া তথ্য প্রচার করা হয়। অর্থাৎ, প্রতি আড়াই দিনে ভারতীয়রা বাংলাদেশকে নিয়ে একটি করে ভুল তথ্য প্রচার করেছে। আজ শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে ফ্যাক্ট চেক বা তথ্য যাচাইকারী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার।
এতে বলা হয়, গত বছর রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে ভারতীয় ৭২টি গণমাধ্যম ৩২টি বিষয়ে মোট ১৩৭টি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেগুলোতে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার করেছে ভারতের বাংলা ভাষার স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল রিপাবলিক বাংলা, ১০টি। এরপর তালিকায় রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, ৯টি।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে এই প্রবণতা নিয়মিত হিসেবে লক্ষ্য করছিল রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের মাস অর্থাৎ আগস্টে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ নিয়ে ভারতীয়দের অপপ্রচার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। প্রথম ছয় মাসে মাত্র ১২টি অপতথ্য ছড়ালেও আগস্টে এক মাসেই প্রচার হয়েছে ৫৩টি অপতথ্য। পরের তিন মাস কিছুটা কমলেও ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার ইস্যুতে ভর করে ফের আগস্টের মতো একই সংখ্যক (৫৩) অপতথ্য প্রচার করেছে ভারতীয়রা।
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয়দের অপতথ্যের প্রচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া প্লাটফর্ম মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স। গেল বছর ১৪৮টি অপতথ্যের মধ্যে ১১৫টিই এক্সের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এক্স ছাড়াও বাংলাদেশকে নিয়ে গত বছর ফেসবুকে ভারতীয় বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অর্ধশতাধিক অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। অপতথ্য প্রচারের তালিকায় আছে ইউটিউব ও ইনস্টাগ্রামের নামও।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময়ে গেল বছরের আগস্ট থেকে ভারতীয়দের অপতথ্য প্রচারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর সরকারবিহীন পরের তিনদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। হামলা হয় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের বাড়ি এবং স্থাপনায়ও। এসব ঘটনাবলির মধ্যেই সাম্প্রদায়িক ভুল তথ্য এবং অপতথ্যের ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট ও সংবাদমাধ্যমে। গত বছর ভারতীয়দের ছড়ানো যে ১৪৮টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার, তার মধ্যে ১১৫টিই সাম্প্রদায়িক অপতথ্য। গেল বছর সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের প্রচারের বড় এক মাধ্যম হয়ে ওঠে এক্স। আগস্ট মাসেই এক্সে ৫১টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার।
অন্তত ১০টি ঘটনায় ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল (এএনআই), এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, জি নিউজ, আজতক, রিপাবলিক বাংলার মতো সংবাদমাধ্যমগুলোতে অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার ২০২৪ সালে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত ভুল তথ্য নিয়ে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণ করে ৩২টি ঘটনায় দেশটির ৭২টি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে।
বাংলাদেশকে জড়িয়ে গেল বছর ভারত থেকে যেসব অপপ্রচার চালানো হয়েছে তাতে ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি জড়ানো হয়েছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। তাঁকে জড়িয়ে অন্তত চারটি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে দুইটি করে, অভিনেত্রী আজমেরি হক বাঁধন ও ছাত্রলীগ নেত্রী আতিকা বিনতে হোসাইনকে জড়িয়ে একটি করে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এর বাইরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছয়টি, বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে দুইটি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে একটি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে দুইটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। অপতথ্যের শিকারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোও।
বাংলাদেশে গেল বছর সময়ে সময়ে নানান ইস্যুতে সরগরম ছিল ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম। বছরজুড়ে রিউমর স্ক্যানার এমন অন্তত ৪০টি ইস্যুতে ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখতে পেয়েছে। এর মধ্যে অন্তত আটটি ইস্যুতে ভারত থেকে পরিচালিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট এবং সে দেশের গণমাধ্যমকেও ভুয়া তথ্য প্রচার করতে দেখা গেছে।
ভারতের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি গেল বছর বাংলাদেশকে নিয়ে অপতথ্যের প্রবাহের প্রসার করেছেন। এই তালিকায় দেশটির রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী অন্তত একটি, বিজেপির বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল অন্তত তিনটি, ত্রিপুরা রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী কর্তৃক অন্তত একটি করে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন, ভারতীয় গণমাধ্যম অপি ইন্ডিয়ার সম্পাদক নুপুর শর্মাসহ আইনজীবী ও নানা পেশার ব্যক্তিত্বরা অপতথ্য দিয়েছেন।