জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে জনগণ সব কিছুর কেন্দ্রে। সব রাষ্ট্রে বা সমাজে সবসময়ই কিছু কর্মক্ষম মানুষ থাকে। এমন কিছু মানুষও থাকে যারা কর্মক্ষম নয়। এসব মানুষের মধ্যে শিশুরা আগামী দিনের কর্মক্ষম নাগরিক। বৃদ্ধরা বিগত দিনে কর্মক্ষম নাগরিক ছিলেন, যাঁদের আয়করে গড়ে উঠেছে আজকের সমৃদ্ধ বর্তমান। অকর্মক্ষম মানুষের মধ্যে আরও রয়েছে অসুস্থ ও প্রতিবন্ধীরা।
সুইডেনে সমাজের অকর্মক্ষম সবার ভরণপোষণের দায়িত্ব কর্মক্ষম মানুষদের ওপর বর্তায়। তাই দেশটিতে কর্মক্ষম মানুষের কাছ থেকে উচ্চহারে আয়কর আদায় করা হয়। সেই অর্থ ব্যবহার করা হয় কর্মজীবী বাবা-মায়ের কর্মঘণ্টার অনুপস্থিতে শিশুর দেখাশোনা ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবায়। এভাবে তৈরি হয় জনকল্যাণমূলক কর্মসংস্থান।
সুইডেন বা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর অধিকাংশ কাজই তেমন সেবামূলক। শিশুর দেখাশোনা, বয়স্কদের সেবা, প্রতিবন্ধীদের সেবার বিষয়গুলো দেখা হয়। এখানেই শেষ নয়, জিডিপির একটা নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহার হয় বৈদেশিক সাহায্যে। বৈশ্বিক উন্নয়নে; শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সমতায়নের মাধ্যমে একটি আগামী বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে জিডিপির এ অর্থ ব্যয় হয়। সুইডেন ছোট দেশ হলেও বৈদেশিক সাহায্যদানকারী দেশ হিসেবে সামনের কাতারে রয়েছে।
মানুষের মূল্যায়ন, সমতা, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা সুইডিস সমাজকে দিয়েছে ভিন্নতা। দিয়েছে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের গৌরবময় মুকুট।
যে কথা বলার জন্য এই লম্বা ভূমিকা, সেটা হলো সুইডেনের স্বাস্থ্যসেবা। দেশটির স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বহুবছর জড়িত আমি। প্রাথমিক দিকে যখন চিকিৎসক হিসেবে কাজ করার লাইসেন্সশিপ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম- তখন পড়াশোনার অবসরে কাজ করেছি দেশটির ওল্ডহোমে। সেখানে বৃদ্ধদের সেবা ও নিজের জীবনযাপন করেছি। ২০০৬ সাল থেকে সুইডেনে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছি। সমাজের দর্পণ “জরুরি বিভাগের” বহু বছরের অভিজ্ঞতায় স্বাস্থ্যসেবাকে আরও গভীরভাবে দেখার, বোঝার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করার জন্যই লিখছি।
জনগণই রাষ্ট্রের মূল। স্বাস্থ্য মৌলিক মানবাধিকারগুলোর মধ্যে একটি। সুতরাং স্বাস্থ্যসেবা শুধু কয়েকজন রোগী দেখা নয়; বরং পুরো জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। সেই জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য সুইডেনে তিনটা সহজ আইন রয়েছে।
এক. রোগী অধিকার আইন। যথাযথ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সম্মতি, অংশগ্রহণ ও স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা এই আইনের মূল বিষয়। এই আইনের মাধ্যমে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। আইনি পর্যবেক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের নিরপেক্ষ সংস্থা রয়েছে।
দুই. রোগী নিরাপত্তা ও সুরক্ষা আইন। এর অধীনে রোগীর নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়, ক্ষতি হয়, চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীর ক্ষতি হয় বা মারা যায় -এমন সব ফ্যাক্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এনে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- রোগীর সঙ্গে আসা কোনো দর্শনার্থী যদি হুমকি-ধামকি দেয় তা বস্তুত রোগীর নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্যসেবাকে বিঘ্ন করার পর্যায়ে পড়ে। আর একটি উদাহরণ- ওয়েটিং রুমে অনেক রোগী বসে আছে, কিন্তু সেখানে সবচেয়ে অসুস্থ রোগীকে চিহ্নিত করতে না পারাটা - রোগী নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন। এটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ব্যবস্থাগত ত্রুটি। কর্মবলকে সঠিক শিক্ষা না দেওয়র জন্য এই দুর্বলতা।
এই আইনটি পর্যবেক্ষণের জন্য আলাদা সংস্থা রয়েছে, যারা ত্রুটিগুলোর তদন্ত করে। এই তদন্তের মূল উদ্দেশ্য কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা নয়– সিস্টেমের ভুল, দুর্বলতা ও ছিদ্রগুলো চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে যেন এসব ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয় তার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।
রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো দুর্ঘটনা বা ত্রুটি হলে তা তদন্ত করার জন্য প্রতিটা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কমিটি থাকে। এই কমিটি তদন্তের পর যদি মনে করে গুরুতর ঘাটতি, ভুল বা অপরাধ রয়েছে– সেই কেস জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে তদন্ত করতে পাঠানো হয়।
গণতন্ত্র জবাবদিহিতার শিকড় তৃণমূল পর্যন্তই এভাবেই বিস্তৃত।
তিন. রোগীর তথ্য সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন। রোগীর তথ্য যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা ও তা সংরক্ষণ করা এই আইনের মূল লক্ষ্য। রোগীর তথ্য লিপিবদ্ধ করা ও তা সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীর।
সুইডেনে এই তিনটি মৌলিক আইনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা সাজানো হয়েছে। যেখানে স্বাস্থ্যসেবায় রোগী রয়েছে কেন্দ্রে। কেন্দ্রের বাইরের পরিধিতে রয়েছে চিকিৎসক, নার্স, ফিজিও, রোগীর আত্মীয়-স্বজন, রোগীর যাতায়াত, অর্থনৈতিক সাপোর্ট, ওষুধ, ওষুধ সরবরাহসহ যাবতীয় সবকিছু। স্বাস্থ্যসেবা শব্দটির অর্থ অনেক বিস্তৃত।
সেই সেবা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত বা রোগীর তথ্য যত্রতত্র ব্যবহার হলে, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই এমনটা ঘটুক না কেন- সবাই আইনের চোখে অপরাধী। নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী।
বিপ্লব শাহনেওয়াজ: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং বিভাগীয় প্রধান, জরুরি বিভাগ, উপসলা ইউনিভার্সিটি হসপিটাল সুইডেন