সেকশন

বুধবার, ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
Independent Television
 

পুষ্পা, কেজিএফ কেন এত জনপ্রিয়তা পায়?

আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৬ পিএম

ভারতে এখন চলছে পুষ্পা–ঝড়। শুধু ভারতেই কেন, ঝড় এক অর্থে চলছে সারা বিশ্বেই। কারণ বড় বাজেটের ভারতীয় সিনেমাগুলো এখন বিশ্বজুড়ে প্রায় একই সময়ে মুক্তি পায়। এরই মধ্যে ‘পুষ্পা টু’ হাজার কোটি রুপির বেশি আয় করে ফেলেছে। সাত দিন চলার আগেই এত বেশি ব্যবসা এর আগে ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কোনো সিনেমা করেনি। কিন্তু কেন এত জনপ্রিয় হলো পুষ্পার গল্প? শুধুই কি কনটেন্টের মানের বিচারে? নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে?

এক্ষেত্রে পুষ্পার সঙ্গে সঙ্গে কেজিএফ–এর প্রসঙ্গও ওঠে। পুষ্পার আগেই কেজিএফ–এর দুটি পর্ব সিনেমা আকারে মুক্তি পেয়ে গেছে। প্রথম পর্বের চেয়ে বক্স অফিসে বেশি তাণ্ডব চালিয়েছে দ্বিতীয় পর্বটি। হাজার কোটি রুপির ওপরে ব্যবসা করেছে, ভারতের সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করা ছবিগুলোর ছোট্ট তালিকাতেও আছে ‘কেজিএফ টু’। পুষ্পার অবস্থাও একই। প্রথম পর্বের চেয়ে দ্বিতীয় পর্বের ঝাল বেশি।  

এখন চোখ বোলানো যাক গল্পের দিকে। কী গল্প বলে এই দুই সিনেমা? মজার ব্যাপার হলো, এখানেও আছে দুর্দান্ত মিল। দুই ছবিতেই একেবারে নিঃস্ব একটা মানুষের সাফল্যের চূড়ায় ওঠার গল্প বলা হয়। দুটিতেই নায়ক ঠিক সৎকার্য করে না। অবৈধ উপায়েই বিত্ত ও ক্ষমতার মালিক বনে যায়। স্রেফ একক ব্যক্তিত্বের গল্প বলে পুষ্পা ও কেজিএফ। বাকি সব চরিত্র আসে কেবলই প্রধান চরিত্র বা প্রোটাগনিস্ট ক্যারেক্টারের নিমিত্তে। অ্যান্টাগনিস্ট ক্যারেক্টার বা সহজ শব্দে খলনায়কেরা বাধা হয়ে দাঁড়ালেও সব উৎরে যায় নায়ক পুষ্পা বা রকি ভাই। এমন মাত্রার প্রতিপত্তি তাদের পায়ে লুটোপুটি খায়, যার কোনো তল পাওয়া যায় না। দেশের মন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী—সবাই হয়ে পড়ে তটস্থ!

এমন কল্পিত এক পৃথিবীর গল্পই বলে কেজিএফ ও পুষ্পা। কল্পিত পৃথিবীর কথা বললে অবশ্য কেজিএফ’কে এগিয়ে রাখতে হবে। কারণ রকি ভাইয়ের জগৎ বাস্তবতা থেকে অনেক বেশি আলাদা। পুষ্পা বরং কিছুটা কমন ম্যানের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে দুই সিনেমাতেই পুষ্পা ও রকির গল্পটা রূপকথার মতো। একদমই কিছু না থাকা, সহায়–সম্বলহীন মানুষের উঠে দাঁড়ানোর কাহিনী দেখা যায়। রকি যেমন বাবা–মা’কে হারিয়ে একা একা জীবন টানে মুম্বাই শহরে। মামুলি গুন্ডা থেকে একসময় হয়ে ওঠে সারা দেশের ডন, সোনার খনির মালিক বনে যায়। অনেক সাধারণ মজদুর কিংবা গণমানুষের জন্য দয়ার সাগর রূপে আবির্ভূত হয়, হয়ে ওঠে আবালবৃদ্ধবনিতার রকি ‘ভাই’। আবার পুষ্পা একজন সাধারণ শ্রমিক থেকে লাল চন্দন কাঠের চোরাচালান চক্রের মাথা হয়ে ওঠে। অন্যের কাছ থেকে কিছুটা সম্মান পাওয়ার জন্যই একে একে সব বাধা ঠেলে সে হয়ে ওঠে সবার ‘ভাউ’।

স্ত্রীর খুশির জন্য সবকিছু করতে রাজি পুষ্পা। ছবি: সংগৃহীতএখানে কয়েকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রকি–পুষ্পার উত্থানে সবচেয়ে বেশি বাধা সৃষ্টি করে টিকে থাকা সিস্টেম। এই সিস্টেম বা বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোই রকি ও পুষ্পাকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না। আর সেই সিস্টেমকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় রকি–পুষ্পা। অর্থাৎ, সমাজের একজন তথাকথিত অজ্ঞাতকুলশীল হঠাৎ করেই সবার ‘বস’ হয়ে ওঠে, সবাইকে তাদের কথা শুনতে ও মানতে বাধ্য হতে হয়। ভেঙে যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুল প্রচলিত বিত্ত–বৈভবের কথিত বেড়াজাল। সিনেমার পর্দায় দেখানো সমাজকাঠামোয় একটা ‘ক্যাওস’ তৈরি হয়। আর তাতে জয়ী হয় একজন কমনম্যান। হ্যাঁ, হয়তো তারা একটা অবৈধ উপায়েই সাফল্যের শিখরে ওঠে, কিন্তু তার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাদের জয়। বেশি গুরুত্ব পায় ‘গরিবের রবিনহুড’ ধারণা।

পুষ্পার আইকনিক স্টাইল। কারও সামনে মাথানত করবে না সে! ছবি: সংগৃহীতএখন প্রশ্ন আসে, এই সিনেমাগুলো মূলত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কোথায়? মূলত ভারত ও ভারতীয় উপমহাদেশে। এই অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থা আসলে কেমন? আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম বলছে, ভারতে ধনী ও গরীবের মধ্যকার বৈষম্য ব্যাপক। দেশটিতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে ৭৭ শতাংশ জাতীয় সম্পদ। ভারতে বিলিয়নেয়ার বা এ ধরনের অতি ধনী ব্যক্তির সংখ্যা ১১৯। অথচ ২০০০ সালে এই সংখ্যাটি ছিল মোটে ৯। এসব হিসাব থেকেই বোঝা যায় ভারতে ধনী ও গরীবের মধ্যকার বৈষম্য কী ভয়ংকর মাত্রায় বেড়ে চলেছে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম একটি প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক যুগে দেশে ধনী-গরীব বৈষম্য বেড়েছে ৮০ গুণ। দেশের উন্নয়ন হলেও এর সুফল পৌঁছায়নি সবার কাছে। দৈনিক প্রথম আলোতে ২০২৩ সালের ২৬ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতেই দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ৫০ বছরে ধনীদের আয় অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে ধনী ও গরিবের আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলেই এই চিত্র উঠে এসেছে।

খুঁজলে পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কাতেও কাছাকাছি চিত্রই পাওয়া যাবে। আর এমন করুণ আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে জীবনকে টেনে নিয়ে চলা সাধারণ জনতা হয়তো এক পর্যায়ে স্বপ্ন দেখতে চায় পুষ্পা বা রকি ভাইয়ের হাত ধরে। তারা জানে যে, সবই সিনেমা, সবই কল্পনা। তবুও এক পর্যায়ে হয়তো তারা রূপালী পর্দাতে হলেও নিজেদের মতো নিঃস্ব বা জীবনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এগিয়ে চলা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে রকি–পুষ্পার ক্ষমতার আস্ফালন এবং অর্থনৈতিক সাফল্য দেখে তৃপ্তি পায়! তবে কি এ কারণেই সাধারণ জনতার মধ্যে জনপ্রিয় হয় পুষ্পার ডায়লগ ‘ঝুঁকেগা নেহি সালা?বলিউডের জনপ্রিয় ও সুঅভিনেতা হিসেবে খ্যাত মনোজ বাজপেয়ি মনে করেন, পুষ্পা বা কেজিএফের সাফল্য মূলত উপরোক্ত কারণেই। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এ দেশের (ভারতের) মানুষগুলো এখন বিষণ্ণ হয়ে গেছে। কারণ তারা অনুভব করে যে, তারা যা চায়, তা পায় না। তাই তারা আল্লু আর্জুনের পুষ্পা এবং ইয়াশের কেজিএফের মধ্যে নিজেদের খুঁজে বেড়ায়। তারা এমন নায়ক খুঁজে বেড়ায়, যারা শেষতক জেতে। আর এই কারণেই টুয়েলভথ ফেইল–এর মতো সিনেমা এত ব্যবসায়িক সাফল্য পায়। কারণ মানুষ ভাবতে পারে যে, একদিন তারাও সফল হবে!’

মনোজ আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমরা একটি আশাহীন দশায় আছি। সুতরাং সমাজ একটি চক্রের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিটি চক্রে মানুষ নিজেদের মতো নায়ক ও নিজেদের সাথে মিল আছে এমন গল্প খুঁজছে। সুতরাং যেসব সিনেমায় এই সময়ের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এবং যেসব অভিনেতা এসব সিনেমায় অভিনয় করছেন, দর্শকেরা সেগুলোই দেখছে।’

এবার মনোজ বাজপেয়ীর বক্তব্য, উপমহাদেশে ধনী–গরীবের ক্রমপ্রসারমান বৈষম্যের পরিসংখ্যান, পুষ্পা–কেজিএফের গল্পের সাযুজ্য এবং ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রাবল্যের বিষয়টি পাশাপাশি রাখা যাক। এক অদ্ভুত কার্যকারণ এক্ষণে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেটি হলো, এতদঅঞ্চলের সাধারণ মানুষ আসলে নিজেদের কখনোই পূরণ না হওয়া স্বপ্নকে রূপালী পর্দায় পুষ্পা ‘ভাউ’ বা রকি ‘ভাই’–এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হতে দেখতে ভালোবাসছে। আর অনেকটা এ কারণেই হয়তো বক্স অফিসে ধুন্ধুমার ব্যবসা করছে রকি বা পুষ্পার রাইজ বা রুল।

তবে হ্যাঁ, এ নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা ও জরিপ হতেই পারে। তখন হয়তো আরও নিখুঁত কার্যকারণ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। এবং এই নিখুঁত কার্যকারণ বের করা অতীব প্রয়োজন। কারণ এর ফলে আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজ ও অর্থনীতির অনেক গূঢ় ও অপ্রিয় সত্য বের হয়ে আসতে পারে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুস্থ ও সুন্দর সমাজ ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়তেই সেসব সত্য জানা প্রয়োজন। তাহলেই হয়তো উপমহাদেশীয় সমাজের অনেক অসুখ সারানো সম্ভব হবে।

কেজিএফ সিনেমার প্রধান চরিত্র রকি ভাই। ছবি: সংগৃহীতশেষটা করা যাক একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। আজ থেকে প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় আগে বাসার জানালা দিয়ে পাড়ার একটি ঝগড়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করা হয়েছিল। এক প্রতিবেশীর সঙ্গে এক রিকশাচালকের তুমুল ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল। রিকশাচালক বিত্তের হিসাবে নিচে থাকার কারণে তাঁর কণ্ঠ বেশ ম্রিয়মান ছিল। তবে অনুচ্চারেও তিনি প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন। আর তাতেই আরও জ্বলে উঠছিলেন প্রতিবেশী মুরুব্বি। রিকশার ভাড়া নিয়ে সেই ঝগড়া এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল এই প্রশ্নে যে—কেন ওই রিকশাচালক প্যাডেলের উপর এক পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন? রিকশার চালক হয়ে এত সাহস তিনি কোথায় পেলেন?

রকি ভাই ‘গ্যাংস্টার’ নয়, একাই যেন ‘মনস্টার!’ ছবি: সংগৃহীত এতটা সামাজিক অবমাননা, অবহেলা ও অসম্মানের শিকার হওয়া ওই রিকশাচালকের মতো মানুষগুলো যদি মালিকের সামনেই সাধারণ মজদুর পুষ্পার পায়ের উপর পা তুলে বসার দৃশ্য দেখে শিস ও হাতে তালি দিয়ে তুমুল হর্ষধ্বনিতে চারদিক মাতিয়ে তোলে, তাহলে তা থামানোর সাধ্য কার!

লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন

[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]   

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় বর্তমানে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা বেশি। সেই ২০২২ সাল থেকেই বেশি। একটি দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক বিতর্কিত করে, দমন করার চেষ্টা করে, কেবলই পুরুষের যৌনবস্তু...
পয়লা বৈশাখ শুধু একটি দিন বা উৎসব নয়–এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার এক জীবন্ত প্রতীক। বাংলা নববর্ষের এই দিনটি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য, ঐক্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইংরেজি নববর্ষের মতো...
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যাই হলো, এ দেশে আদর্শ নায়ক বা ব্যক্তিত্বের অভাব। আমরা যাদের আইডল বানাই, সময়ের ফেরে তারাই এমন রূপ পরিগ্রহ করে যে, শ্রদ্ধার বারোটা বেজে যায় একেবারে। তারা এমন সব কাজ করতে...
এ দেশে আসলে কোন বিষয়টির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে, তাহলে তালিকার প্রথম দিকেই হয়তো চলে আসবে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের ‘হা হা’ রিঅ্যাকশন!  স্বাভাবিকভাবেই যাদের বেশি হাসি পায় বা যারা অট্টহাসি দেয়,...
লোডিং...

এলাকার খবর

 
By clicking ”Accept”, you agree to the storing of cookies on your device to enhance site navigation, analyze site usage, and improve marketing.