শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার এবং তাদের মদতপুষ্ট আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরই জেরে গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরামসহ চারজন। এই নৃশংস ঘটনা গোটা দেশের বিবেক নাড়িয়ে দেয়। ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাজপথে নামে সাধারণ মানুষ। স্বতঃস্ফূর্ত এক গণ‑আন্দোলনে রূপ নেয় ছাত্রদের এই ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’। সরকার আরও কঠোর হলে দীর্ঘ হতে থাকে লাশের মিছিল। মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয় বাংলদেশ। অবশেষে এক রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার।
এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্র-জনতার ঐকমত্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ১০ নভেম্বর এই সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, যিনি ‘ব্যাচেলর’, ‘টেলিভিশন’, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, ‘৪২০’, ‘ক্যারাম’, ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রভৃতি নাটক-সিনেমার জন্য দর্শকদের কাছে বেশ সমাদৃত। সম্প্রতি মুক্তি পায় তাঁর ‘৮৪০’ নামের একটি চলচ্চিত্র, যেটিকে তিনি ‘আওয়ামী দুঃশাসনের এক্স-রে রিপোর্ট’ বলছেন।
এর আগে ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রে ফারুকী দেখিয়েছেন কুসংস্কার আর গোঁড়ামিপূর্ণ এক গ্রামীণ সমাজের চিত্র। একটু-আধটু প্রেম-বিরহের ছোঁয়াও ছিল সেখানে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ চলচ্চিত্রে ‘এক বেকার যুবকের’ চোখে তিনি ফুটিয়ে তোলেন ঘুণে খাওয়া সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রতিচ্ছবি। জনপ্রিয় ‘৪২০’ ধারাবাহিক নাটকে দেখা যায়, দেশীয় প্রেক্ষাপটে রাজনীতির অলিগলি, যা মূলত একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে মনে করিয়ে দেয়! অন্যদিকে, ‘পিঁপড়াবিদ্যা’য় তিনি তুলে এনেছেন পড়াশোনা শেষে এক বেকার যুবকের চিরাচরিত কঠিন বাস্তবতা, যেখানে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানির হঠকারিতার চিত্রও ফুটে ওঠে।
বিভিন্ন বিপ্লব কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার কালে কবি-সাহিত্যিকদের দেখা যায় সামনের সারিতে। চিলির কবি পাবলো নেরুদা নিজ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে যেমন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলেন, তেমনি স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এস টি কোলরিজ, লর্ড বায়রনসহ অনেকেই। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে বিশ্বমঞ্চে। চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এর ব্যতিক্রম নন। রুশ বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কিংবদন্তি নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন। এখনও পৃথিবীর নানা স্থানে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন অনেক নির্মাতা।
গত জুলাই-আগস্টে বিশ্বের প্রথম জেন-জি বিপ্লবের সময় ছাত্র-জনতার পাশে ছিলেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, খিজির হায়াত খানসহ শোবিজ তারকাদের অনেকে। প্রসঙ্গত, দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজ তখন রাজপথে নেমেছিল। নির্মাতা ফারুকীকে সরাসরি রাজপথে পাওয়া না গেলেও তিনি এই আন্দোলনের প্রথম থেকেই সামাজিকমাধ্যমে ফ্যাসিবাদ ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে এই নির্মাতা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকেই তাঁর পুরোনো বিভিন্ন বিষয় সামনে এনে সমালোচনা করেছেন। সমালোচনাকারীদের অভিযোগ, এটা মূলত বিগত ১০-১৫ বছর ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফারুকীর নীরব থাকা এবং ‘ক্ষমতা’র আশপাশে থাকার ইস্যু!
আসলে কোনো ব্যক্তিই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তবে ফারুকী যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, সেই প্রমাণও তিনি অনেকবারই দিয়েছেন। ১৪ নভেম্বর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েও নিজের ‘শিল্পী সত্তা’র জানান দিয়েছেন। সেই পোস্টে তিনি বলেন, ‘একবার ভাবেন, হিটলারের আমলে কোনো শিল্পী হিটলারের মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তার গাছের গোড়ায় পানি ঢাললে তাকে ইতিহাস কী হিসেবে বিচার করতো? আপনি আওয়ামী লীগ সমর্থক হতে পারেন, বিএনপি সমর্থক হতে পারেন, কিন্তু শিল্পী হলে কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণহত্যা, গুমের মতো অপরাধের সাথে জড়িত ফ্যাসিস্টের পক্ষে কথা বলতে পারেন না, ফ্যাসিজমের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করতে পারেন না।’
এই কথায় যারা ভিন্নমত ধারণ করেন, তারা কি অনুভূতিতে একটু আঘাত পেলেন? পেলে পেতেও পারেন! তবে আশা রাখি, ফারুকী তাঁর পোস্টে যা বলেছেন, তিনি তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দায়িত্ব পাওয়াটা, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যিই এক মাইলফলক। কবি শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধান কি মেনে নেবেন আমার প্রস্তাবগুলো/ পররাষ্ট্রনীতির বদলে প্রেম, মন্ত্রীর বদলে কবি/ মাইক্রোফোনের বদলে বিহ্বল বকুলের ঘ্রাণ?’ অবশেষে কবিকে না পেলেও রাষ্ট্রপ্রধান ঠিকই একজন ‘নির্মাতা’কে মেনে নিয়েছেন। তরুণ বয়সে অবশ্য যাঁর কবিতা লেখারও ঝোঁক ছিল। এবার দেখার পালা যে, দেশের সংস্কৃতি জগতে পরিবর্তন আসে কতটা?
যদিও আমূল পরিবর্তন সাধন করা, কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। কেননা, বিশাল জনসংখ্যার নিজেদেরও পরিবর্তন হওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। এ ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিশাল এক কর্মযজ্ঞের জায়গা। ইতিমধ্যে অবশ্য বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাঁর মন্ত্রণালয়, যা বেশ আশা জাগানিয়া। তরুণদের মধ্যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে ৭টি অগ্রাধিকার কার্যক্রম ঘোষণা করেছে মন্ত্রণালয়। এসব কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ‘রিমেম্বারিং মুনসুন রিভ্যুলিউশন’, ‘তারুণ্যের উৎসব’, ‘দেশব্যাপী প্রতিভা সন্ধান’, ‘ডিজিটাল ওরাল হিস্ট্রি প্রকল্প’, ‘বাংলা একাডেমি সৃজনশীল লেখালেখি কর্মশালা ও গবেষণা প্রকল্প’, ‘জাতীয় জাদুঘরে আধুনিক ভিডিও প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা স্থাপন’ ও ‘শো-ক্রিয়েটর ওয়ার্কশপ’। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য, ৫ আগস্টের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ‘মুক্তমঞ্চ’ চালু হয়েছে। সংস্কারের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক। দেশের অন্য মুক্তমঞ্চগুলোও চালুর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। পাশাপাশি রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে আরও কিছু মঞ্চ নির্মাণের যে দাবি রয়েছে দীর্ঘদিনের, সেদিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে। আরও অনেক না বলা বিষয় রয়েছে। এখন দেখা যাক কতটা বদল আসে?
লেখক: সহ–সম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]