পয়লা বৈশাখ শুধু একটি দিন বা উৎসব নয়–এটি বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার এক জীবন্ত প্রতীক। বাংলা নববর্ষের এই দিনটি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য, ঐক্য ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইংরেজি নববর্ষের মতো অন্ধকার রাতের আড়ম্বর নয়, বাংলা নববর্ষের সূচনা হয় ভোরের আলোয়, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে–প্রকৃতির নবজাগরণের মতোই। এটি শুধু একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং পুরোনোকে পেছনে ফেলে নতুনের দিকে যাত্রার এক মহোৎসব।
কখনও শরৎ, কখনও অগ্রহায়ণ, আবার কখনও বৈশাখ–সময়ের প্রবাহে বারবার রূপ বদলেছে বাঙালির নববর্ষ। আজ যে পয়লা বৈশাখকে আমরা বাংলা নববর্ষ হিসেবে উদ্যাপন করি, তার যাত্রাপথ ছিল বন্ধুর। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমরাও বছর শুরুর দিনে আনন্দে মেতে উঠি–গান, নাচ, আয়োজন আর উচ্ছ্বাসে। তবে এককালে এদিন ছিল নিছকই হিসাব-নিকাশের সময়, ব্যবসায়ীদের খাতা বদলের দিন–হালখাতা।
‘হাল’ শব্দটির শিকড় সংস্কৃত ও ফারসি–সংস্কৃত ‘হল’ অর্থাৎ লাঙল, আর ফারসিতে ‘হাল’ মানে নতুন। এই দুই অর্থই মিলে গড়ে তোলে পয়লা বৈশাখের প্রকৃত তাৎপর্য–নতুনের চাষাবাদ। মোগল আমলে হিজরি চান্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী খাজনা আদায়ের সময় কৃষকেরা পড়তেন দুরবস্থায়। কারণ, চাষ তো চন্দ্র নয়, সূর্যের গতিপথেই নির্ভরশীল। এ বৈপরীত্য ঘোচাতে সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন ‘ফসলি সন’, যা পরে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিতি পায়। কেউ কেউ বলেন, এর সূচনা আরও আগে, রাজা শশাঙ্কের সময়েই।
নববর্ষের উৎসব হিসেবে পয়লা বৈশাখের আনুষ্ঠানিক শুরু আকবরের আমল থেকেই। ইতিহাস বলছে, ৯৬৩ হিজরি (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) সালে সিংহাসনে বসেই এই নববৎসর উদ্যাপন শুরু করেন আকবর। এই দিনটিতে প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা পরিশোধ করত, জমিদাররা আসত মুর্শিদাবাদের দরবারে। নবাব মুর্শিদকুলি খান চালু করেন ‘পুণ্যাহ’ নামের এক অনুষ্ঠান, যা আদতে ছিল হালখাতারই আরেক রূপ–তবে জমকালো, জাঁকজমকপূর্ণ ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী। এই ঐতিহ্যই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববাংলায়, আর সেখান থেকে পশ্চিমেও।
কিন্তু আজ যে নববর্ষকে আমরা সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ বলে জানি, তা উনিশ শতকের আগেও সমাজে তেমন জায়গা করে নিতে পারেনি। তখন নববর্ষ বলতে বোঝানো হতো ইংরেজি নববর্ষ–যার রূপ ধরা আছে ঈশ্বর গুপ্তর কবিতায়। বাংলা নববর্ষ তখনো মূলত ছিল রাজস্ব ও কৃষি অর্থনীতির একটি বাহন।
তৎকালীন সমাজে বর্ষবিদায় মানেই গাজন, চড়কের উৎসব। হুতোম প্যাঁচার ভাষায়, শিবের কাছে মাথা চালানো, ঢাকের তালে সন্ন্যাসীদের তাণ্ডব আর গঙ্গাজলের ছিটানো–এমনই ছিল সেই উৎসব। তার পরদিন, নববর্ষে জমিদারের হাতে প্রজাদের উপহার, একে অপরের আপ্যায়ন। অর্থনৈতিক আদানপ্রদান ধীরে ধীরে রূপ নেয় সামাজিক বন্ধনে।
এভাবেই কৃষিপ্রধান সমাজে নতুন ফসলের উৎসব থেকে নববর্ষ হয়ে ওঠে নব জীবনের আহ্বান। পয়লা বৈশাখে যা কিছু পুরোনো, জীর্ণ, ক্লান্ত–তাকে বিদায় জানিয়ে আহ্বান জানানো হয় নতুন আলো, নতুন ভাবনার। আর সেই আলো ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান–সবাই মিলে পালন করতেন এই উৎসব, ভাগ করে নিতেন আনন্দ আর শুভেচ্ছা।
অজিতকুমার গুহ স্মৃতিচারণে লেখেন, ঢেঁকিঘরের শব্দ, চৈতালী ফসল, কনকচাঁপার গন্ধ, কালবৈশাখীর স্পর্শ–এই সব মিলেই যেন পয়লা বৈশাখ ছিল এক জীবনময় অভিজ্ঞতা। দীনেন্দ্রকুমার রায়ের চোখে বৈশাখী মেলা–যেখানে পিতলের বাসন, মাটির পুতুল, কদমা-খাগরাই আর মনিহারি দ্রব্যে গমগম করে ওঠে জনপদ। আহমদ ছফা লিখেছেন, হিন্দু প্রতিবেশীর পাঠানো নাড়ু-মোয়ার ‘সিগ্যাইছা পাতিল’ আর কোষ্ঠী পাঠের স্মৃতি। একটি দিন, যার প্রতিটি স্তরে ছিল অন্তরঙ্গতা, আন্তরিকতা ও সম্মিলন।
এই পয়লা বৈশাখকেই চিরস্থায়ী রূপ দিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি নববর্ষকে শুধু হিসাব-নিকাশের দিন হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন নবচেতনার আগমনী বার্তা হিসেবে। তাঁর গান, কবিতা, নাটকে বারবার এসেছে ‘পুরাতন সে যাবেই চলে’–এই প্রত্যাশা। শ্যামলী প্রাঙ্গণে তাঁর সেই কথাগুলো আজও প্রতিধ্বনিত হয়–‘নববর্ষ ধরতে গেলে রোজই তো লোকের নববর্ষ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘নববর্ষ আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করুক’–এটি শুধু উৎসবের দিন নয়, আত্মসমীক্ষা ও নবযাত্রারও সময়। আজকের যান্ত্রিক জীবনে আমরা নববর্ষকে শুধু বাহ্যিক আড়ম্বরে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। কিন্তু এর প্রকৃত তাৎপর্য হলো–পুরোনোকে বিদায় দিয়ে নতুনের স্বাগত জানানো; সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন করা; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া।
পয়লা বৈশাখ কেবল একটি দিন নয়, এটি বাঙালির চেতনার প্রতীক। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রাজনীতি ও সংস্কৃতির যোগফল। এই উৎসবের মূল কথা হলো নিজস্বতাকে ভালোবাসা, তাকে ধরে রাখা এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা ছড়িয়ে দেওয়া। বাঙালির অস্তিত্ব বাঁচাতে হলে আমাদের এই দিনটির তাৎপর্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে এবং যথাযথভাবে উদ্যাপন করতে হবে।
কিন্তু আমরা নববর্ষকে আলাদা তাৎপর্য দিয়ে অনুভব করতে শিখিনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের নাগরিক জীবনে, নববর্ষ আজ নিতান্তই এক বিনোদনের লগ্ন: ‘এসো হে বৈশাখ’ সহযোগে সকাল বেলার একটা অনুষ্ঠান কিংবা ছোট্ট পরিসরে সাজানো সান্ধ্য আসর, ইতস্তত নানা আকারের আল্পনা, সুসজ্জিত হাতপাখা, বাংলা অথবা রোমান ‘শুভ নববর্ষ’ লেখা অভিবাদনের পাশেই ‘অথেনটিক বেঙ্গলি কুইজ়িন’-এর আমন্ত্রণ! সারা বছর ধরে এমন আরও বিস্তর লগ্ন আসে এবং চলে যায়, পিছনে রেখে যায় প্রভূত কলরবের প্রতিধ্বনি, যতক্ষণ না পরবর্তী বিনোদনের কোলাহল এসে তাকে গ্রাস করে। নববর্ষ ‘আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ’ করার কথাই ওঠে না।
উৎসব আছে ঠিকই, কিন্তু প্রাণ যেন নেই। বর্ণিল সাজ, মিষ্টির প্যাকেট, নতুন জামা, হালখাতার আমন্ত্রণ–সব কেমন যেন যান্ত্রিক। দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক, রাজনীতির কলুষতা, সমাজের বিভাজন আমাদের একলা করে দিয়েছে। অথচ, পয়লা বৈশাখ তো ছিল মিলনের দিন। রবীন্দ্র-নজরুল, রজনীকান্ত, শামসুর রহমান–সবাই এই দিনে গেয়েছেন শুভর গান, অশুভকে দূর করার গান।
আমরা কি পারি না আবার সেই প্রভাতের দিকে তাকিয়ে বলতে–‘রাত্রির অন্ধকার কেটে যাক/ জয় হোক সর্বমানবের’?
পয়লা বৈশাখ হোক সেই নবজাগরণের অঙ্গীকার।
লেখক: গবেষক ও লেখক
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]