বুদ্ধিজীবীদের সবাই সব সময়ে যে সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরোধিতা করেছেন, তা নয়। বুদ্ধিজীবী সমাজের যে অংশ জনসাধারণের স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে পেয়েছেন, তাঁদের কাজে স্বাধীনতার আন্দোলন লাভবান হয়েছে অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে। এই অংশটিই ছিল বৃহত্তর অংশ এবং এই অংশের বৃহত্তর অংশ এসেছিল তরুণ সমাজের মধ্য থেকে। তাঁরা তরুণ ছিলেন বলে তাঁদের মধ্যে একটা নবীন আদর্শবাদ ছিল, ছিল প্রলোভন এবং ভীতির কাছে আত্মসমর্পণ না করবার সাহস। তদুপরি পূর্ববর্তীদের তুলনায় এদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটাও ছিল কিছুটা শক্তিশালী।
জনসাধারণের আশা পূরণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে, তার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়েছিল ১৯৪৮ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও দেশের সকল বুদ্ধিজীবীই যে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন, তা নয়। ঢাকাতেই ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে একটি ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল অধ্যাপক ও ছাত্রদের নিয়ে। এঁরা সংস্কারমুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার ওপর গুরুত্ব দিতেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও এঁদের মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন উঠেছিল।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে পাকিস্তানবাদীরা পরবর্তীকালে অনেক বাগাড়ম্বর করেছে, কিন্তু নজরুল ইসলাম কোনোদিনই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না। তিনি বরং আস্থা রেখেছিলেন শ্রমিক কৃষকদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে, এমন কি যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে মঙ্গলের প্রত্যাশা দেখেছিলেন তাঁরাও কিছুটা চিন্তিত না হয়ে পারেননি। চিন্তিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালু করবার উদ্যোগ-প্রয়োজন দেখে। ১৯৪৮-এর গোড়ার দিকেই অধ্যাপক ও ছাত্রদের একাংশ দাবি তুললেন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে। সরকারের দিক থেকে বিরোধিতা এল, প্রত্যাশিত বিরোধিতা। এবং তখনই, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জায়গায় নতুন এক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ঘটনাটা তেমন কোনো ঘটা না করেই ঘটল। অধিকাংশ মানুষই লক্ষ্য করল না রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য যে কী, এ যে কোন পর্যন্ত যাবে সেটা শাসকেরা তখন বোঝেনি, এমন কি তাঁরাও বোঝেননি যাঁরা শুরু করেন এই আন্দোলন।
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যখন জন্ম হয়, তখন সেই জন্মের পেছনে একটি অতিপ্রধান ভূমিকা ছিল ভয়ের। মুসলিম মধ্যবিত্ত ভয় পেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই মনে করে। সেই ভয় তারা সংক্রমিত করে দিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে। প্রধানত ভয়ের কারণেই ইংরেজের ভয়, তারও চেয়ে বড় ভয় হিন্দুর ভয়–তার তাড়নাতেই মুসলমানদের প্রায় সব ভোটই গিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বাক্সে। এখন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এল এই নতুন ভয়–উর্দুর অর্থাৎ উর্দুভাষাভাষীদের। আশঙ্কা হলো উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ফলে বাঙালিরা চিরকালের জন্য বোবা হয়ে যাবে, তারা গোলাম হয়ে যাবে পাঞ্জাবিদের। বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো সেই ভয় জাগিয়ে দিল মানুষকে। প্রথমে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশকে, পরে ছাত্রদের, এবং তারও পরে সমগ্র দেশবাসীকে। বড় ভয় এসে ছোট ভয়কে, নিরাপত্তার ভয়কে, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারার ভয়কে জয় করে নিল। ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি দেখল তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন মরিয়া হয়ে ওঠা ভিন্ন অন্য কোনো পথ রইল না। যে শাসকেরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল, সেই শাসকেরাই আজ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সকল মানুষের স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন সেই জ্ঞানটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এনে দিল। শাসকদের স্ববিরোধিতার পুরাতন নাটক এইখানেও নতুন করে অভিনীত হলো, স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই তারা স্বার্থ বিনষ্ট করল।
বলাই বাহুল্য যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। থাকলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতো না। এই আন্দোলন অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এর গতিধারা প্রসারিত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের পুরোনো ব্যাধি, ইংরেজ আমলে এই ব্যাধির প্রকোপে আমরা অনেক দুর্ভোগ ভোগ করেছি। পাশাপাশি থেকেও দুই সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে পায়নি। ইংরেজ যুগে সৃষ্ট অতিশয় সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জীবন ও লেখকদের উপস্থিতির সামান্যতাটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, মুসলমান মধ্যবিত্ত সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে পিছিয়ে-পড়া মুসলমানের এমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যাতে করে সাহিত্যে মুসলিম জীবন অনায়াসে চিত্রিত হতে পারে।
১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দেশবিভাগ মুসলমান মধ্যবিত্ত তো চেয়েছিল বটেই, শেষ পর্যন্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষেও না চেয়ে উপায় থাকেনি। ১৯০৫-এ যাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন, ১৯৪৭-এ তাঁরা আর বিরোধী থাকতে পারেনি। এই রকমের একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশে, সাম্প্রদায়িকতার ফলে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রে এত তাড়াতাড়ি যে অসাম্প্রদায়িক গণআন্দোলন গড়ে উঠতে পারল, এর দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানের ব্যর্থতা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং সেই ব্যর্থতা দেখে বাংলাদেশের মানুষ ভয় পেয়েছিল।
শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও বটে। সমাজতন্ত্রের কথা আন্দোলনের কালে স্পষ্ট করে বলা হয়নি বটে, কিন্তু সন্দেহ নেই এ আন্দোলন ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার আন্দোলন। বাংলাদেশের সন্ত্রস্ত মুসলমানেরা একদিন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, এর সাহায্যে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে বলে। সেই অস্ত্র যখন উল্টো কাজ করবে বলে ভয় হলো, তখন তারা একে পরিত্যাগ করে অন্য একটা অস্ত্র শাণিত করে তুলতে চাইল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই অস্ত্রই মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছে, যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি সম্পূর্ণ নতুন ও অতিশয় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সরবরাহ করেছে তরুণ ছাত্রদের জীবনে। সে অভিজ্ঞতা আত্মত্যাগের ও নির্যাতনভোগের। বাংলাদেশের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট দুর্ভোগ সহ্য করেনি, পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত দেয়নি বলে তরুণ সমাজের মনে একটা লজ্জা ছিল। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন রক্ত বইলো, যখন কারাভোগ এল, এল পুলিশের পিছু নেওয়া, তখন লজ্জা ঘুচল কিছুটা, দ্বিধা কাটল অনেক পরিমাণে, দৃঢ়চিত্ততা এল সঙ্গে সঙ্গে।
এ দেশের লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, চিত্রকর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যে শিল্পের যে পরিমাণ উপাদান যত সহজে পেয়েছেন, তেমন অন্য কোথাও পাননি। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনোদিন ম্লান হয়নি, ১৯৫২ সালের পর প্রতিটি বছর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। বাইরে রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন কমেনি, ক্রমশ বেড়েছে। তার কারণ এই আন্দোলন শক্তি পেয়েছে পাকিস্তানের ব্যর্থতা থেকে, যে ব্যর্থতার বোঝা দিনকে দিন বাড়ছিল, শক্তি পেয়েছে জনসাধারণের অসন্তোষ থেকে, যে অসন্তোষও প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের পুঞ্জিভূত রূপ হচ্ছে এই আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে দিয়ে সাধারণ মানুষ জানিয়ে দিল যে, মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের হাতে তাদের স্বার্থ যে নিরাপদ নয়। পরে এই সত্য আরও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, যত প্রত্যক্ষ হয়েছে তত বেড়েছে বিক্ষোভ। বিক্ষোভ সব সময়ে প্রকাশের পথ পায়নি, যখন পায়নি, তখন তা আরও বেশি দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি। শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির উপাদান জোগাতে পেরেছে আরও এই কারণে যে, এই আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা অত্যন্ত বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্তের দৃষ্টি অনেক সময়ে ছিল পশ্চিমমুখো, তাদের মনে অভিমান ছিল, তাদের মাতৃভাষা বাংলা কিনা এ নিয়েও এক সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বুদ্ধিজীবীদেরকে দেশের সঙ্গে একাত্ম করে দিল। তাঁরা ঘরে ফিরে এলেন গভীর ভালোবাসা নিয়ে। তাঁরা দেশের মানুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এতদিন ধর্ম ছিল ঐক্যের বন্ধন, এখন সেখানে এল ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারির পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী যখন দেশের কথা বলছেন, তখন অধিকাংশ সময় তাঁরা আসলে বাংলাদেশের কথাই বলেছেন, পাকিস্তানের কথা নয়। দেশপ্রেম তাঁদের দেশদ্রোহী করেছে এক অর্থে। বায়ান্নর পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মমতার ক্ষেত্রে, চর্চার ক্ষেত্রে বান ডেকে জোয়ার এসেছে। রচনার উৎকর্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক পরিমাণে। এর ফলে শুধু যে ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে তা নয়, মানুষের মধ্যে ঐক্যের বোধ বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা, বেড়েছে সুন্দরতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ। বাইরে যাই বলুক, পাকিস্তানের শাসকরা একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল, তাই গণহত্যা শুরু করেই তারা ছুটে গিয়েছিল শহীদ মিনারের দিকে, মিনারকে ভেঙে দিয়ে আক্রোশ মিটিয়েছিল তারা। আর মিনারের জায়গায় মসজিদ তৈরি করে তারা তাদের পুরাতন কৌশল নতুন করে প্রকাশ করেছিল: কৌশলটা হলো ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিক্ষোভকে স্তিমিত করা।
বাংলা ভাষার ব্যাপারে পশ্চিমা শাসকবর্গ একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছে প্রথমটায়। হয়তো তার পেছনে ভয় ছিল, স্বার্থ নষ্ট হবার ভয়, কিন্তু পরে যখন তারা দেখেছে যে এ-আন্দোলন কিছুতেই স্তব্ধ হবার নয় তখন ১৯৫৬ সালে এবং পরে ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলাকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু ততোদিনে বাংলাদেশের মানুষ আরো অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। পাকিস্তানে যে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এটা তাদের জানা হয়ে গেছে, এবং জানা হয়ে গেছে বলে ততোদিনে তারা শুধু ভাষার অধিকার না, পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবি করেছে। এবং গণহত্যার মুখে দেশটাই স্বাধীন করে নিয়েছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]