সারা আরা মাহমুদ, শহীদ জায়া। তাঁর আদরের নাম ঝিনু। ১৯৬৬ সালে সতের বছর নয় মাস বয়সে বিয়ে হয় প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের সাথে। মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত আলতাফ মাহমুদ ঝিনুকে বিয়ে করে পান মা ও পাঁচ ভাই দুই বোনের এক সংসার। সবচেয়ে মহার্ঘ্য যে সম্পদ পান তা হলো মায়ের আদর। মা যেন পেলেন তাঁর বড় ছেলেকে। আদর করে ডাকতেন ‘আলতু’। যত রাতই হোক আলতু কড়া নাড়লেই সজাগ হতেন তিনি।
ঝিনু পড়াশোনা চালিয়ে যান। সংসার মায়ের দায়িত্বে। কোলে আসে কন্যা শাওন। সুরে আনন্দে ভালোবাসার ছন্দে প্রজাপতির পাখায় ভর করে কাটছিল ঝিনুর জীবন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি জান্তার শোষণ ও শাসন বাড়ে। পাশাপাশি বাড়ছিল আলতাফ মাহমুদের প্রতিবাদী গানের পরিবেশনা। আলতাফ সুর করেন একুশের সেই অমর সঙ্গীত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি... ’ যা বাঙালির পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে চিরকাল। বাঙালির পরিচয়ের বাহক অমর এ সঙ্গীত।
এরপর আসে ১৯৭১ সালের ভয়াল ২৫ মার্চের কালো রাত। ঝিনু রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টো দিকের বাড়িতে রাত জেগে দেখেন দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। কয়েকজন পুলিশ লুঙ্গি পরে পালিয়ে এসে আলতাফ মাহমুদের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন। শুরু হয়ে যায় বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। বলছি বটে বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ তবে এই যুদ্ধে এ ভূখণ্ডের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অংশ নেন।
ঝিনু হারমনিয়াম নিয়ে বোন শিমূলকে শিখিয়ে দেন একের পর এক গান। সুর ধরা থাকে শিমূলের কণ্ঠে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হলে সেগুলো রেকর্ড করে নানাভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে ছোট্ট শাওনকে নিয়ে ভয়ে কাটে ঝিনুর সময়। আলতাফ ঘর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে যান নানাভাবে। ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্যরা এ বাড়িকে কেন্দ্র করে তাদের অপারেশন চালাতে থাকেন। অস্ত্র জমা রাখা হয় এই বাড়িতে। সবজি বিক্রেতা বা অন্য কোন বেশে সে অস্ত্র আনা–নেওয়া করা হতো। ঝিনু, ঝিনুর মা সকলেই এ কাজে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট সেই ভয়াল দিন রাতে দরজায় বেপরোয়া কড়াঘাত। হুড়মুড় করে ঢোকে পাকিস্তানি সেনারা। আর্মির গাড়িতে বসা ‘এক সহযোদ্ধা’। আলতাফ কে জানতে চাইলে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে আসেন আলতাফ মাহমুদ। মা আগলে ধরতে চান, কিন্তু লাভ হয় না। পাঁচ ভাই আর আলতাফকে নিয়ে বাড়ির পিছনের খালি জায়গায় গিয়ে তাকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে অস্ত্রের ট্রাঙ্ক বের করা হয়। কোলে শাওনকে নিয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকে ঝিনু। ঝিনুর কান্না, মায়ের অনুনয় উপেক্ষা করে পাঁচ ভাই আর আলতাফকে চোখ বেঁধে আর্মির গাড়িতে তোলা হয়। শূন্য হয় ঝিনুর সংসার। ‘সহযোদ্ধা’ নামে এক প্রতারকের বয়ানে আলতাফের বাড়িতে অস্ত্রের সন্ধান পায় পাকিস্তানি আর্মি।
সেই ৩০ আগস্ট থেকে শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। শত নির্যাতনেও সহযোদ্ধাদের একটা তথ্যও বলেননি আলতাফ। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বহু সহযোদ্ধা। একে একে ছাড়া পায় পাঁচ ভাইসহ আরো অনেক সহযোদ্ধা। ছাড়া পান না আলতাফ। ঝিনু অপেক্ষায় বসে থাকেন, আসবে আলতু! কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ভাত খেতে দিলে কাঁচামরিচ চান আলতাফ মাহমুদ। সাদা ভাতে উপড়ে ফেলা নখের লাল রক্ত আর সবুজ কাঁচা মরিচ রচনা করে বাংলার পতাকা।
স্বাধীনতা আসে। আসেন না আলতাফ। ঝিনুর অপেক্ষা শেষ হয় না। শাওন তার দিদুর সঙ্গী হয়ে হাইকোর্টের মাজার থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় খুঁজে বেড়ায় বাবাকে। ফেরেন না আলতাফ। শাওন বড় হতে থাকে। ৭৩ সালে আলতাফের পরিবারকে বসবাসের জন্য আউটার সার্কুলার রোডে একটি বাড়ি দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। সারা আরা মাহমুদকে শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি দেওয়া হয়। শুরু হয় শাওনকে নিয়ে তরুণী ঝিনুর জীবনযুদ্ধ।
কিন্তু ১৯৮০ সালে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে পথে নামিয়ে দেওয়া হয় আলতাফ মাহমুদের পরিবারকে। শাওনের হাত ধরে মা’কে নিয়ে আক্ষরিক অর্থে গাছতলায় স্থান হয় ঝিনুর।
শিল্পকলার একাডেমির নানা পদে আসীন হয়ে চলচ্চিত্র বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে অবসরে যান সারা আরা মাহমুদ। তবু মা–মেয়ের অপেক্ষা শেষ হয় না। আলতু আসবে এই আশায় কাটে তাঁদের দিন।
শাওনের জীবনের চড়াই–উতরাইয়ের সঙ্গী তার মা। ছোটখাটো পুতুলের মত ঝিনু কতটা সাহসী আর জীবনযুদ্ধে জয়ী একজন মানুষ, তাকে দেখে বুঝতে পারা যায় না।
হঠাৎ করেই বয়স কামড় বসায় ঝিনুর শরীরে। এত বছরের একাকী যুদ্ধের চাপ যেন আর নিতে পারেন না তিনি। অকাল বার্ধক্য ঘিরে ধরে। পা ভেঙে যায়। অপারেশন হয়। হাসপাতালে অচেতনে বারবার আলতুর সাথে কথা বলেন। বলেন, আলতু আর মা তাঁকে নিতে এসেছেন। তারপরও সেরে ওঠেন কন্যার পরিচর্যায়। চলে যাবেন বলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। শেষে এই ভাষার মাসেই ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সন্ধ্যা ৬: ৩০ মিনিটে প্রিয় আলতুর সাথে মিলিত হতে অনন্তে পাড়ি জমালেন সারা আরা মাহমুদ।
সারা জীবন মানুষের ভালোবাসা ও সম্মানে বেঁচে থাকা সারা আরা মাহমুদের প্রয়াণ কত মানুষকে যে শোকে আকুল করেছে, তা গোনার বাইরে। সবাইকে কাঁদিয়ে শাওনকে একা করে মা পাড়ি জমালেন। আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি আপনাকে, জানি না। তবে একাকী জীবনযুদ্ধে আপনি দিয়ে গেছেন এ জাতিকে অনেক। শ্রদ্ধা, শহীদ জায়া।
লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মী
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]