স্বাধীনতার মাস। সংকল্প গ্রহণের মাস, সংকল্প পূরণের মাস। সংকল্পের দৃঢ়তাকে ভিত্তি করে জাতীয় জীবনে সফলতা আর অর্জনের মাস। জাগরণের মাস। সচেতনতার মাস। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা জাতীয় জীবনে যে বঞ্চনার সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তির জন্য পথ চলা শুরু হয়েছিল ১৯৭১‑এর মার্চেই। বহু আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ বেয়ে মানুষ ১৯৭১ সালে স্বজাতির শাসনের স্বাধীনতা লাভ করে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তা লাভের প্রত্যাশায় দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার করে ফেলার পর আজও সাধারণ মানুষ তাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকেই জনগণ তাদের চাহিদার সাথে প্রাপ্তির সম্পর্ককে আবিষ্কার করতে একের পর এক আন্দোলন সংগ্রাম করেছে কিন্তু মসনদপ্রেমীরা জাতিগত মুক্তির করণীয় পথে হেঁটেছে এমন নমুনা পওয়া কঠিন। বিপরীতে গণমানুষের চাহিদা দিনে দিনে অবজ্ঞার শিকার হয়েছে এবং মসনদপ্রেমীদের নিজস্ব একটা অভিজাত সমাজ গঠনে নিবেদিত হতে দেখা গেছে। সাধারণ মানুষ এখনো মুক্তির আশায় এগিয়ে চলেছে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ জুলাই/২৪। মেধা ও কোটার আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার পতনের ইতিহাস।
স্বৈরাচারী শাসন নিপতিত হলেও বর্তমান শাসন যে সাধারণ মানুষের মুক্তি আনবে, চাহিদা পূরণে নিবেদিত হবে–ক্ষমতাসীনরা এমন প্রত্যাশার করবার কোনো প্রকার চিহ্ন গত ছয় মাসে দৃশ্যমান হয়নি। অনেকে হয়তো বলতে পারেন হতাশ হবার সময় হয়তো এখনো আসেনি। তবে মুক্তির প্রত্যাশায় সামনে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে সেটা বোধ করি কেউই দৃঢ়তার সাথে বলতে পারবেন না। বর্তমানে অন্তহীন সমস্যার বহিঃপ্রকাশ চলমান। চলমান এ সমস্যাগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষের সমস্যা একরকম আবার ক্ষমতাবানদের সমস্যা অন্যরকম। কৃষকের সমস্যা একরকম আবার শ্রমিকের সমস্যা অন্যরকম। খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যা একরকম আবার জনগণের মাথার ওপর লাঠি ঘোরানো মানুষগুলোর সমস্যা অন্যরকম। রাজনৈতিক সমস্যা একরকম আবার সামাজিক সমস্যা অন্যরকম। ব্যবসায়ীদের সমস্যা একরকম, আবার ক্রেতাদের সমস্যা অন্যরকম। চাকরিজীবীর সমস্যা একরকম, আবার সেবাগ্রহীতার সমস্যা অন্যরকম। সমস্যায় জর্জরিত দেশটায় সবাই নিজ নিজ সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসবার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বলে বোধ হয়। তবে সম্মিলিতভাবে সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই। এত কিছুর মধ্যে সুবিধালোভীদের ঝোপ বুঝে কোপ মারার মানসিকতাই প্রকট।
দেশের রাজধানী থেকে উপজেলা–সর্বত্র সবাই দাবির ঝাঁপি খুলে বসেছে। শতসহস্র দাবি আদায়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আন্দোলনের এহেন পন্থায় জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠে গেলেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই আন্দোলনকারীদের। কেউ চাকরি চাইছে, কেউ পুরোনো চাকরি ফেরত চাইছে, কেউ আরও ক্ষমতা চাইছে, কেউ ক্ষমতার ভাগ চাইছে, কেউ সংস্কার চাইছে, কেউ নির্বাচন চাইছে, কেউ সংবিধান সংশোধন চাইছে, কেউ নতুন সংবিধান চাইছে, কেউ চিকিৎসার নিশ্চয়তা চাইছে, কেউ ভাতা চাইছে, কেউ পদোন্নতি চাইছে, কেউ পুরা প্রশাসনের ওপর লাঠি ঘোরানোর ক্ষমতা চাইছে, কেউ যোগ্যতার স্বীকৃতি চাইছে, কেউ নিত্য প্রযোজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ চাইছে, কেউ কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য চাইছে, কেউ দখলমুক্ত সড়ক চাইছে, কেউ সরকারি জমি দখলমুক্ত চাইছে, কেউ নদনদী রক্ষা চাইছে, কেউ পরিবেশ রক্ষা চাইছে, কেউ আইন‑শৃঙ্খলা রক্ষার উন্নয়ন চাইছে, কেউ আইনের শাসনের নিশ্চয়তা চাইছে, কেউ পদত্যাগ চাইছে, কেউ মব জাস্টিস বন্ধ চাইছে, কেউ মব জাস্টিসের আইন হাতে তুলে নিতে চাইছে, কেউ সাবেক স্বৈরাশাসকদের বিচার চাইছে, কেউ একই অপরাধে আটক সাবেকদের মুক্তি চাইছে, কেউ নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ চাইছে, কেউ নারীর স্বাধীনতা হরণ করতে চাইছে, কেউ জাতীয় নির্বাচন আগে চাইছে, কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চাইছে, কেউ কল-কারখানায় শৃঙ্খলা চাইছে, কেউ শ্রমের নায্য মজুরি চাইছে, কেউ সিন্ডিকেট ভাংতে চাইছে, কেউ ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা চাইছে, কেউ পাচার হওয়া টাকা ফেরত চাইছে। প্রতিদিন এমন আরও কত শতসহস্র বিচিত্র চাওয়ায় যে ইথার সরগরম, তার হিসাব রাখা কঠিন। চাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও চাওয়ার পথ ও পদ্ধতির কারণে জনজীবনে যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত তা বিবেচনার দাবি রাখে নিশ্চয়ই।
দুর্ভাগা এ দেশটা আজ ভরে গেছে বিচিত্র চরিত্রের মানুষে, যাদের মুখের কথার সাথে অন্তরের কথার মিল খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। কখন যে, কোথায়, কে কী ঘটাচ্ছে তা সাধারণ জনগণের বোধের বাইরে বলেই মনে হয়। দেশে এখন আবার চলছে জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা। অস্বীকার করা যাবে না, এসব প্রতিষ্ঠানের নামকরণ একটা সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে এসেছিল বিগত সরকারের আমলে। কিন্তু নাম পরিবর্তনের এ প্রতিযোগিতার আড়ালে বাঙালি জাতির ইতিহাস মুছে ফেলার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা উদ্বেগজনক। নামকরণে ব্যবহৃত কীর্তিমান মানুষগুলো দেশ ও জাতির জীবনে এক একজন কিংবদন্তি। কিন্তু আজ ইতিহাস যারা সৃষ্টি করতে পারছে না, পারেনি, বোধকরি তারাই ইতিহাস ধ্বংস করে উল্লাস করছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানের নতুন এ নামকরণে অতীতের মতো সাধারণ মানুষকে উপেক্ষিতই রাখা হয়েছে। তবে জনগণকে উপেক্ষা করা হলেও এই নির্বিষ পরিবর্তনের কারণে কত শত কোটি টাকার বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তার হিসাব কেউ করেছে বলে মনে হয় না। অথচ এর পুরো মাসুল জনগণকেই দিতে হবে। এই যেমন সরকারের লাঠি ব্যবস্থাপনার প্রধান হাতিয়ার প্রশাসন ক্যাডারদের মধ্যে কে, কখন, কীভাবে বঞ্চিত হয়েছে, তা খুঁজে খুঁজে বের করে কোটি কোটি টাকা তাদের দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। অথচ দেশে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের কথা কেউ মনেও করছে না, তাদের কথা শোনাও যাচ্ছে না। ক্ষমতার সহযোগী হয়ে প্রশাসন ক্যাডাররাই শুধু নিজেদের টাইম বার পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে দেশের অন্য কর্মচারীদের পাপটা কী? শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেলের কথা গত কত বছর ধরে ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে, তার হিসেব মনে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জাতির কল্যাণ বিবেচনায় শিক্ষকদের এ টাইম বার পদোন্নতি জরুরি ছিল, প্রয়োজন ছিল, নয় কি? কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টরা শিক্ষকদের এই মানবিক দাবিকে অন্তরের মণিকোঠার সযত্নে রেখে দিয়েছে। ফলে এই অন্তহীন বৈষম্যই শিক্ষার বেহাল দশার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদের দেশের অসীম ক্ষমতাবান সরকার কখন কীভাবে কার প্রতি সদয় হবেন, বলা খু্ব মুশকিল। জনগণ চাইলেই সব দিতে হবে, জনগণ চাইলেই বিবেচনা করতে হবে–এমন ভাবনা তাদের মধ্যে নেই। তেনারা এখন অতীত মুছে নতুন বাংলাদেশ গড়তে ব্যস্ত। অতীত মুছতে গিয়ে সরকার বড় বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। কিন্তু প্রতিদিনের যাপিত জীবনের ছোট ছোট সমস্যা যে জনজীবনে গভীর সংকট সৃষ্টি করছে, সে ব্যাপারে তারা উদাসীন। চারদিকে শুধু কথার পিঠে কথা সাজিয়ে সাধারণ জনগণের চাওয়াগুলো ধামাচাপার চেষ্টা চলমান। অথচ সাধারণের চাওয়া গুরুত্ব পেলে অনেক বড় সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। মনে রাখা প্রয়োজন নাগরিক জীবনকে ক্রমান্বয়ে সংকট থেকে বের করা না হলে দেশকে ভালো রাখা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতার মাসে তাই শুরু হোক নতুন পথ চলা, শুরু হোক নতুন কথা বলা। সরকারকে বাণীর কালচার থেকে বের করে আনতে সাধারণ মানুষের সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। সরকারেরও কথা আর কাজের মিল রেখে এগিয়ে চলার রীতির প্রচলন দেখানো প্রয়োজন। অতীতে যারা দুর্নীতি, সন্ত্রাস, পাচার, জালিয়াতি, ইত্যাদি করেছে, তাদের বেকসুর খালাস করে নতুনদের নামে মামলা দেওয়ার রেওয়াজ কতটা যুক্তিসঙ্গত তা বিবেচনার দাবি রাখে। একদিকে এহেন কাজ করে অপরদিকে জনগণকে শান্তির বাণী দেওয়া সমীচীন কিনা ভাবার সময় এসেছে। নতুন সরকারের মাত্র আট মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো তাদের অনেক পরিকল্পনার মধ্যে জনগণকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই জনগণের সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। এ যে আমাদের মুক্তির মাস, আমাদের স্বাধীনতার মাস।
লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]