অবশেষে যুদ্ধবিরতি। আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা বলছি। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় শেষ পর্যন্ত দুই দেশ এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। ভারতের রাজনীতির একটা বিশেষ অস্ত্র হল পাকিস্তান-বিরোধী অবস্থান। তাদের রাজনৈতিক দল আর ব্যক্তিত্বরা কত বেশি পাকিস্তান‑বিরোধী অবস্থান নিতে পারে আর সম্ভব হলে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করতে পারে, তার ওপর তাদের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে। এটা পাকিস্তান বিরোধিতা বললে কিছুটা ভুল হবে। এটা এখন কঠিন মুসলিম বিদ্বেষে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগাম নামক স্থানে প্রায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটককে হত্যার মধ্য দিয়ে। সন্ত্রাসীরা সময় নিয়ে পর্যটকদের সাথে কথা বলে মোদিকে তাদের হুমকির বার্তা পৌঁছে দিতে বলে আস্তে ধীরে স্থান ত্যাগ করে। কিন্তু ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে তারা নির্বিঘ্নে কীভাবে কেটে পড়ল, আজ পর্যন্ত তার হদিস পাওয়া গেল না। খোদ ভারতের ভেতরে নানা সন্দেহ আছে। কারণ, এত কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে এ ধরনের হামলা চালানো খুবই কঠিন।
ঘটনার পরপরই ভারতের পক্ষ থেকে দাবি উঠল, ওরা সব পাকিস্তান থেকে আসা সন্ত্রাসী। এর সব দায় পাকিস্তানের। পাকিস্তান এর স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে বলে। কিন্তু ভারত তার প্রতি কর্ণপাত না করে চরম প্রতিশোধের ঘোষণা দেয়। সন্ত্রাসী হামলা কিন্তু নতুন কোনো সমস্যা নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ বিবাদে জড়িয়ে থাকা দেশগুলোতে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অহরহই সন্ত্রাসী হামলা হয়। সেখানে স্কুলের শিশুদের পর্যন্ত গুলি করে মারে সন্ত্রাসীরা। এ জন্য কেউ যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে না। কারণ, সন্ত্রাসীরা যেকোনো দেশেরই হতে পারে। তাই বলে সেই দেশকে দায়ী করে সেই দেশের নিরীহ জনসাধারণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, এটা কি কোনো যুক্তি হতে পারে? উপরন্তু যদি উপযুক্ত তথ্য‑প্রমাণ না থাকে।
যুক্তি অবশ্য আছে, তবে তা রাজনৈতিক স্বার্থের যুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছিল এই অজুহাত যে, ইরাক নাকি মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি করছে। এতে প্রাণ গেল লক্ষ মানুষের, যারা একান্তই নিরপরাধ। আবার একইভাবে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অজুহাতে আফগানিস্তানে গেড়ে বসল আমেরিকা। শেষমেষ যদিও তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রাণ গেছে বহু মার্কিন সৈন্যের। আফগানিস্তান নাকি তাদের জন্য এক মূর্তিমান বিভীষিকা ছিল। অবশেষে আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় তারা।
এবারে ভারতের কথায় আসা যাক। প্রথমে হুমকি, তারপর হঠাৎ আক্রমণ। অনেক সময় এই পর্যায়ে শুধু হুমকিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু তা না পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থাপনায় শুরু হলো ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হামলা। পাকিস্তানও পুরো প্রস্তুত ছিল। শুরু হলো জলে-স্থলে-আকাশে আক্রমণ‑পালটা আক্রমণ। ভারতের আশা ছিল–এভাবে আক্রমণের মুখে পাকিস্তান অসহায় বোধ করবে। কিছুটা হলেও পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এর ফলাফল হবে শুভ। বিশেষত ভারতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ বিল নিয়ে ভারতের মুসলমানদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে এই ধরনের একটা ঘটনা জনগণের দৃষ্টি অন্য খাতে খুব সহজেই প্রবাহিত করা যাবে। সেই সাথে মুসলমানদের আরও কোণঠাসা করা যাবে।
যেহেতু পাকিস্তান মুসলিম দেশ, তাদের সাথে সংঘর্ষের জেরে ভারতের মুসলমানদের ওপর দমনপীড়নে আরও সুবিধা হবে। কিন্তু বিধি বাম। ভুল করে তারা সাপের লেজে পা দিয়ে বসেছে। এ রকমটা যে হতে পারে, তা কেউ আশা করেনি। ভারত প্রথম আক্রমণ শুরু করে। বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি এবং অনেকগুলো জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের দাবি করে। তারপর শুরু হয় পাকিস্তানের আক্রমণ। পাকিস্তানের যে দাবি, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। পাকিস্তান বেশ কয়েকটা ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করে। এগুলোর মধ্য ফ্রান্সের তৈরি রাফাল বিমান ভূপতিত হওয়ার ঘটনা ছিল ভারতের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর। সেই সাথে রাশিয়ার তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস ৪০০ ধ্বংস হওয়ার দাবিও করেছে পাকিস্তান। এ দাবি সত্য হলে তাও কম বিব্রতকর নয় ভারতের জন্য। কারণ, এই দুই অস্ত্র নিয়ে ভারতের গর্বের শেষ নেই।
এ ছাড়া আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আসছে। যদিও যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক মিথ্যা তথ্য থাকে। বিবদমান উভয় পক্ষই তাদের সাফল্য দাবি করে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য দেয়। এটা যুদ্ধ কৌশলের একটা অংশ। কিন্তু রাফাল বিমান ধ্বংসের দাবির সত্যতা পাওয়া গেল খোদ নির্মাতা কোম্পানির বক্তব্যে। তাদের মতে এটাই রাফাল বিমান ভূপাতিত হওয়ার প্রথম ঘটনা। অন্যদিকে এই বিমান নাকি ভূপতিত হয়েছে জে-১০সি নামক চীনা বিমানের হামলায়। পাকিস্তানের সমরাস্ত্র ভাণ্ডারের সিংহ ভাগ চীনা অস্ত্র। এ ছাড়া আছে তুরস্কের ড্রোন আর মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান। পাকিস্তানের এই সক্ষমতার পেছনে দুটো জিনিস কাজ করেছে–এক. তাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, যেটা তারা অর্জন করেছে রাশিয়া ও আমেরিকা এই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে অফগানিস্তান সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে। দ্বিতীয়টা হলো ওদের জেহাদি চেতনা।
এই যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক অস্ত্র ব্যবসায়ীদের কারও পৌষ মাস, আবার কারও সর্বনাশ। ইতিমধ্যে নাকি রাফাল বিমান প্রস্তুতকারী কোম্পানির শেয়ারের দর পড়ে গেছে। অন্যদিকে চীনা অস্ত্রের ওপর তেমন আস্থা ছিল না। কেননা এগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। এবারে এগুলোর সফল পরীক্ষা অস্ত্রের বাজারে বড় মাপের সাফল্য বয়ে আনবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশও নাকি চীনা এই বিমান ক্রয় করতে যাচ্ছে। সুতরাং এতকাল পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসায়ে যে আধিপত্য ছিল চীনা অস্ত্র নিশ্চিতভাবে তা কিছুটা হলেও খর্ব করবে। ছোট দেশের মধ্যে তুরস্ক আর ইসরায়েলের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ড্রোন ব্যবসায় তুরস্ক এগিয়ে গেল একধাপ। পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও আছে যে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে এরা দেদারসে অস্ত্র ব্যবসা করে। তাই এই যুদ্ধ তাদের রমরমা ব্যবসার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এবারে আসা যাক রাজনীতিতে। যুদ্ধের ফল ভারতে মোদি সরকারের জন্য সুখকর হবে না, এটা ধরেই নিতে হচ্ছে। যদি দেখা যেত যে, পাকিস্তান ভারতীয় আক্রমণে বিপুল ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে–তাহলে মোদি সরকারের এই বীরত্ব গাথা ভোটের বাক্সে উপচে পড়ত। তবে এতে মোদির দলের মুসলিম বিদ্বেষ কমবে এমন কিছু আশা করা যায় না। বরঞ্চ অপমানের জ্বালা বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। তাতে কারও কিছু যায় আসে না। বরঞ্চ তাদের দেশের ভেতর অশান্তি আর বিচ্ছিন্নতার দাবানল আরও বেশি করে জ্বলে উঠবে।
এই যুদ্ধের সাফল্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি আস্থা আর নির্ভরতা বহুগুণে বৃদ্ধি করবে। গণতন্ত্রের পথে হাঁটার চেয়ে ভারতকে প্রতিহত করার মনস্তত্ত্ব অনেক বেশি প্রবল হবে জনমনে। এমনকি আশপাশের দেশগুলোতে ভারত বিরোধী মনোভাব প্রবল হবে। আর এতে সবচেয়ে সুবিধা হবে চীনের। দক্ষিণ এশিয়ায় সব দিক থেকে তাদের আধিপত্য আরও নিরঙ্কুশ হবে। যার যাই লাভ হোক না কেন, ক্ষতিটা হলো সাধারণ মানুষের, যারা রাজনীতি বোঝে না, যারা চায় শান্তিতে দু মুঠো খেয়ে পরে বাঁচতে। কিন্তু রাজনীতি আর অস্ত্রের ব্যবসা তা হতে দেবে না।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান (ব্যবসায় শিক্ষা), বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাস্কাট, ওমান
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]