দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ গায়ানায় বহু ভারতীয় থাকলেও দীর্ঘ ৫৬ বছরেও ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী সে দেশে সফরে যাননি। এবার সেই অপবাদ ঘুচিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গত বুধবার ব্রাজিলের পাশের ছোট্ট দেশ গায়ানায় পা রেখেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিমানবন্দরেই তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন গায়ানার প্রেসিডেন্ট ইরফান আলী এবং তাঁর মন্ত্রিপরিষদের এক ডজনেরও বেশি সদস্য। এমনকি মোদিকে গায়ানার সর্বোচ্চ সম্মাননাও জানানো হয়েছে। কারণ, গায়নার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই ভারতীয়।
এ ছাড়া আরও নানা কারণে ভারতের সঙ্গে গায়ানার সম্পর্ক বেশ গভীর। যেমন গায়ানার প্রেসিডেন্ট ইরফান আলীসহ অন্তত ৮০০ ব্যক্তি ভারতের টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকনোমিক কোঅপারেশন‑এর সাবেক ছাত্র।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সর্বশেষ ১৯৬৮ সালে গায়ানা সফরে গিয়েছিলেন। এরপর গত বছরের এপ্রিলে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গায়ানা, পানামা, কলম্বিয়া ও ডমিনিকান রিপাবলিক সফরে গিয়েছিলেন। ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি গায়ানা গেলেন ৫৬ বছর পর।
তবে মোদির এই সফরকে সাধারণ কোনো রাষ্ট্রীয় সফর মনে করছেন না আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। ভারতীয় অধ্যুষিত দেশটিতে শুধু ভারতীয়দের সঙ্গে দেখা করতেই মোদি গিয়েছিলেন, তা মনে করছেন না তাঁরা।
মোদির গায়ানা সফর ঘিরে বিশ্লেষকদের আলোচনায় প্রথমেই রয়েছে তেল ইস্যুটি। কারণ, সম্প্রতি জ্বালানি তেলের বিপুল মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে গায়ানায়। ধারণা করা হচ্ছে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার পরই সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠবে গায়ানা।
এদিকে ভারতকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। ২০২৩‑২৪ অর্থবছরে ভারতের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ। শুধু তেল আমদানি বাবদই ভারতকে ১৩২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়।
এমন কঠিন বাস্তবতায় তেল আমদানির জন্য গায়ানাকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছেন নরেন্দ্র মোদি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক হরি শেশাসায়ী বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। অনেকটা ‘‘আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড’’ সিনড্রোমে ভুগছে এই অঞ্চল।’
মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই অঞ্চলটিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ২০২১ সালে মেক্সিকো, ২০২২ সালে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে এবং ২০২৩ সালে পানামা, গায়ানা, কলম্বিয়া ও ডমিনিক রিপাবলিকান সফর করেছেন। এসব দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছেন।
এখন বাণিজ্য উন্নয়নে নজর দিতে চান মোদি। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই গায়ানা সফরে গেলেন। বিশ্লেষক হরি শেশাসায়ী বলেন, লাতিন আমেরিকার এই অঞ্চলটি ভারতীয় ব্যাবসায়ীদের জন্য ‘গোল্ডিলক্স জোন’। এটি আমেরিকা ও ইউরোপের একটি অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে তেল উত্তোলনের দিক থেকে প্রথমে রয়েছে ভেনেজুয়েলা। তবে অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ২০২৬ সালের মধ্যে তেল উত্তোলনের দিক থেকে ভেনেজুয়েলাকে ছাড়িয়ে যাবে গায়ানা।
জ্বালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ‘ওপেক’ জানিয়েছে, ওপেকের বাইরে অন্যতম তেল উত্তোলক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে গায়ানা।
২০১৫ সালে তেলের খনির সন্ধান পায় গায়ানা। তেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গায়ানার মাটির নিচে অন্তত ১ হাজার ১০০ কোটি ব্যারেল তেল রয়েছে। এটি সারা বিশ্বের খনিজ তেলের প্রায় ১৮ শতাংশ।
খনির সন্ধান পাওয়ার পর থেকে তেলের রপ্তানি বাড়িয়েছে গায়ানা। সরকারি হিসাবমতে, ২০২১ সালে এক দিনে ১ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বিক্রি করেছে গায়ানা সরকার।
আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে গায়ানার তেল রপ্তানি ৯ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করছেন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিদিন ৯ লাখ ব্যারেল তেল বিক্রি করবে গায়ানা।
এদিকে ভারত হচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ। প্রতি বছরই ভারতকে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করতে হয়। বর্তমানে খানিকটা স্বল্পমূল্যে রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনছে ভারত। কিন্তু কতদিন রাশিয়া স্বল্পমূল্যে তেল বিক্রি অব্যাহত রাখবে, সেটি অনিশ্চিত। এ কারণে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গায়ানার সঙ্গে তেল চুক্তি করতে চাচ্ছেন মোদি।
এ নিয়ে বৈঠক করতে চলতি বছরের শুরুতেই দিল্লি এসেছিলেন গায়ানার প্রাকৃতিক সম্পদমন্ত্রী বিক্রম। তিনি ভারতের পেট্রলিয়ামমন্ত্রী হরদীপ সিংহ পুরীর সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর বলেছিলেন, ‘ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি তেলচুক্তি করা যায় কিনা, তা নিয়ে আমরা শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেব।’
এখন পর্যন্ত ভারত ও গায়ানা দীর্ঘমেয়াদি তেলচুক্তি না করলেও একটি সমঝোতা চুক্তি করেছে ভারতের পেট্রলিয়াম মন্ত্রণালয় এবং গায়ানার প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয়। চুক্তিতে গায়ানায় তেলের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ভারতীয় সংস্থাগুলোর যুক্ত থাকার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গায়ানায় প্রতিরক্ষা বাজার সম্প্রসারিত করার চেষ্টা করছে ভারত। সম্প্রতি গায়ানাকে দুটি ‘ডার্নিয়ার‑২২৮’ উড়োজাহাজ উপহার দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ওই উড়োজাহাজগুলো তৈরি করেছে ভারতীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিন্দুস্তান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেড। এরপর থেকে ভারতের কাছ থেকে উড়োজাহাজ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষাযন্ত্র কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে গায়ানা সরকার। এ সবের বাইরেও ওষুধ শিল্প, বায়ো ফুয়েল, সঙ্কর ধাতু ইত্যাদির ভারতীয় বাজার তৈরির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে গায়ানায়।
সম্প্রতি আড়াই কোটি ডলার ব্যয়ে জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে গায়ানা। সেই প্রকল্পে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে মোদি সরকার। এ ছাড়া ৫০টি সৌরশক্তিচালিত ট্র্যাফিক আলো, পয়ঃপ্রণালী ঠিক রাখার পাম্প এবং জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র নির্মাণে গায়ানাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভারত। করোনা মহামারির সময়েও গায়ানায় টীকা পাঠিয়েছিল দিল্লি।
তেলসমৃদ্ধ গায়ানার দিকে নজর রয়েছে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীনেরও। চীন এরই মধ্যে সেখানে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্প শুরু করে দিয়েছে। এ কারণে চীনের আগেই গায়ানার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে নিজের কবজায় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মোদি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গায়ানা ছাড়াও ভেনেজুয়েলার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কিনতে চায় ভারত। তবে কিছু নিষেধাজ্ঞার কারণে তা এখনো সম্ভব হচ্ছে না।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ইকনোমিক টাইমস, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও এনডিটিভি