গত ১৮ মার্চ মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানার পর থেকে দেশটির নৃশংস জান্তা সরকার সারা বিশ্বের কাছে তার কোমল দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করছে। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সম্প্রতি একটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন ভূমিকম্পে আহতদের দেখতে। তিনি বিদেশিদের কাছেও অনুরোধ করছেন, তাঁরা যেন মিয়ানমারে সাহায্য পাঠান।
অথচ চার বছর আগে এই জান্তা সরকারই মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থী নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলে করেছে এবং সমগ্র দেশকে একটি বিকট গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গত চার বছরে মিয়ানমারে যে বিপুল মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, এখন তার সুবিধা নিতে চাচ্ছে জান্তা সরকার।
মাত্রই কয়েক দিন আগে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপেছে মিয়ানমার। মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। প্রকৃত তথ্য পাওয়া কঠিন, কারণ ভূমিকম্পে নেটওয়ার্কগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের ডেটা পরিষেবার ওপরেও জান্তা সরকার কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে রেখেছে, যাতে সাধারণ মানুষ প্রকৃত তথ্য না পায়।
স্থানীয় সাংবাদিকেরাও কঠোর নজরদারির মধ্যে কাজ করেন। জান্তা সরকার বলেছে, মিয়ানমারে বিদেশি সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বলেছে, ভূমিকম্পের আকার ও মাত্রা দেখে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেখানে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ভূমিকম্পটি মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। মাইক্রোসফটের এআই ফর গুড ল্যাবের স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫০০টির বেশি ভবন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলজুড়ে এখনো ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, জীবনযাপনের মৌলিক জিনিসপত্রগুলো পাওয়া যাচ্ছে না।
এরই মধ্যে সেখানে কলেরা দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, কলেরা ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদিও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো কলেরা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তবে তাদের কাজ চলছে খুবই ধীর গতিতে। কারণ রাস্তায় রাস্তায় ধ্বংসযজ্ঞ। ইয়াঙ্গুন থেকে মান্দালয়ে সড়কপথে যেতে প্রায় ১৩ ঘণ্টা সময় লাগছে। আগে যেখানে সময় লাগত সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা।
ভূমিকম্পের কিছু সময় পরেই জান্তার বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো ঘোষণা দেয়, তারা যুদ্ধ স্থগিত করছে, যাতে উদ্ধারকাজ দ্রুত শুরু করা যায়।
অথচ জান্তা সরকারের সেনবাহিনী ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর ২ এপ্রিল যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। তারা বলে, আগামী ২০ দিন তারা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না।
উত্তর মিয়ানসারে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি বলেছে, ‘আমরা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও জান্তা বাহিনী যুদ্ধবিরতি মানেনি। তারা ১ এপ্রিল হামলা চালিয়ে আমাদের অন্তত ৩০ জন তরুণ সৈনকে হত্যা করেছে।’
মান্দালয়ের পশ্চিমের শহর সাগাইং, ভূমিকম্পে যে শহরটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই শহরের বাসিন্দারা বলেছে, তারা এই গত পরশু দিনেও বোমা হামলার শিকার হয়েছে।
একজন বিদ্রোহী যোদ্ধা বলেন, এখানকার বেশির ভাগ তরুণ ভূমিকম্পে উদ্ধারকর্মী কিংবা ত্রাণকর্মী হিসেবে কাজ করতে চান কিন্তু জান্তা বাহিনীর হামলার ভয়ে তাদের বাধ্য হয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
জাতিসংঘ অভিযোগ করে বলেছে, তারা বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে সাহায্য পাঠাতে চায় কিন্তু চেকপয়েন্টগুলোতে জান্তা সরকার বাধা দিচ্ছে। ওই চেকপয়েন্টগুলো পার হয়ে সাহায্য যেতে দিচ্ছে না তারা। এমনকি গত ১ এপ্রিল চীনা রেডক্রস পরিচালিত একটি ত্রাণের গাড়িতে গুলি করেছে জান্তা বাহিনীর সেনারা।
চীনা রেডক্রস জানিয়েছে, তারা এমন একটি অঞ্চলের ভেতর দিয়ে ত্রাণের গাড়ি নিয়ে মান্দালয়ের দিকে যাচ্ছিল, যে অঞ্চলটি জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। অঞ্চলটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির দখলে রয়েছে।
বলে রাখা ভালো, ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে দুটি শহর—মান্দালয় ও সাগাইং, সেগুলো জান্তা বাহিনীর দখলে রয়েছে। কিন্তু এর আশপাশের এলাকাগুলো রয়েছে বিদ্রোহীদের দখলে।
কো জাও জাও নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, তিনি গত ৩০ মার্চ সাগাইংয়ে একটি ধসে পড়া বাড়িতে আটকে থাকা দুজনকে উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। সেখানে জান্তা সরকারের পুলিশ ও সেনা সদস্যরাও ছিলেন। কিন্তু তারা কো জাও জাওকে কোনা উদ্ধারকাজ করতে দেননি। উল্টো তাকে চোর ও লুটপাটকারী আখ্যা দিয়েছেন।
অশ্রুশিক্ত চোখে কো জাও জাও বলেন, ‘আমি যাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলাম, তারা শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছে। জান্তা সেনারা তাদের উদ্ধার করেনি এমনকি আমাকেও উদ্ধার করতে দেয়নি। অথচ আমি পেশায় একজন মেকানিক, আমার কাছে উদ্ধার করার মতো যথেষ্ট সরঞ্জাম ছিল।’
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বিদেশ থেকে যেসব সাহায্য আসছে, তার সিংগ ভাগই রাজধানী নেপিদোতে পাঠাচ্ছে জান্তা সরকার। ভূমিকম্পে নেপিদো খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বটে, তবে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের কাছাকাছি অঞ্চল যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ততটা নয়। ফলে ওই সব ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের চেয়ে নেপিদোতে বেশি ত্রাণ পাঠানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
উচিত ছিল চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড সীমান্তজুড়ে মিয়ানমারের যেসব অঞ্চল রয়েছে সেগুলোতে বেশি বেশি সাহায্য পাঠানো। কিন্তু ওই অঞ্চলগুলোর ওপর জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অঞ্চলগুলো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর দখলে রয়েছে। তবে থিংক ট্যাংক আনাগাট ইনিশিয়েটিভসের বিশ্লেষক নায়ানথা লিন বলেন, ‘বিদ্রোহীরা শুধু বিদ্রোহী যোদ্ধাই নয়, কোনো কোনো অঞ্চলে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে চমৎকার কাজ করছে।’
ভূমিকম্পের আগে থেকেই জান্তা সরকার মিয়ানমারের বহু অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল। বাধ্য হয়ে জান্তাপ্রধান বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দৌড়ঝাঁপও শুরু করেন। মিন অং হ্লাইং রাশিয়া ও বেলারুশ ছুটে যান। এর আগে গত বছর তিনি চীন সফর করেছেন।
গত ৪ এপ্রিল তিনি বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর জোট ‘বিমসটেক’–এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে যান। অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করার পর এটিই ছিল জান্তাপ্রধানের প্রথম কোনো বড় সম্মেলনে যোগ দেওয়া। তিনি এই বৈশ্বিক সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন যে, মিয়ানমার এখন এক গভীর মানবিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এই সঙ্কট মোকাবিলার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, জান্তাপ্রধানের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া নরম কোমল রূপ তাঁর নির্মম শাসনকেই বরং আরও দীর্ঘায়িত ও শক্তিশালী করবে।
দ্য ইকনোমিস্ট থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মারুফ ইসলাম