২০১৬ সালের কথা। অব্রিদ শাইন পরিচালিত ‘অ্যাকশন হিরো বিজু’ সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে মালায়ালাম চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে (মলিউডে) পথচলা শুরু জিতু আশরাফের। পরবর্তী ৬ বছরে সহ-পরিচালক পরিচয়ে আরও চারটি সিনেমায় কাজ করেন তিনি। ৫ সিনেমায় অন্যের সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার নিজেই নেমে পড়েন মাঠে। আর সিনেমা নির্মাণের জন্য বেছে নেন মোটে দুটি সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার শাহী কবিরকে।
সংখ্যায় দুটি হলেও ‘জোসেফ’ আর ‘নায়াত্তু’র চিত্রনাট্য দিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন কবির। এর মধ্যে নায়াত্তু’তে পুলিশ চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে প্রশংসায় ভাসেন কানচাকো বোবান। জিতু আশরাফ তার প্রথম সিনেমার জন্য বেছে নেন শাহী কবির-বোবান জুটিকেই। কবিরের চিত্রনাট্যে ভর করে নির্মাণ করেন ক্রাইম-থ্রিলার সিনেমা ‘অফিসার অন ডিউটি’।
সিনেমার নাম থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, এখানে অফিসার বলতে পুলিশ অফিসারকেই বোঝানো হয়েছে। সিনেমার প্রধান চরিত্র পুলিশ অফিসার হরিশঙ্কর (বোবান) তাঁর কাজের প্রতি নিবেদিত প্রাণ হলেও ভীষণ রগচটা। আর নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি বলে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পাশাপাশি ডিএসপি থেকে সিআই হিসেবে পদাবনতি হয়েছিল হরিশঙ্করের।
কিন্তু বহিষ্কার আর পদাবনতি কি হরিশঙ্করকে বদলাতে পেরেছে? বহিষ্কারাদেশ শেষে পুনরায় কাজে যোগ দিলেও পুরোনো মেজাজ যায়নি কেরালার আলুভা পুলিশ স্টেশনের সিআইয়ের। ফের চাকরিতে যোগদানের প্রথম দিনই থানায় গিয়ে জড়িয়ে পড়ে সোনার চেইন জালিয়াতির মামলায়। আর সে মামলা তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে সন্ধান মেলে কেউটের। সামনে আসতে থাকে একের পর এক গুরুতর অপরাধের ঘটনা।
রহস্যের কূল-কিনারা খুঁজে বের করার আগেই অভিযোগকারীর মেয়ে আত্মহত্যা করলে গল্প নতুন মোড় নেয়। বাস্তব জীবনে হরিশঙ্করের মেয়েও আত্মহত্যা করেছে, আর মেয়ের স্বেচ্ছায় প্রাণনাশের পেছনে হরিকেই দায়ী করে তার স্ত্রী গীতা। এ নিয়ে কেরালার এই সিআই–এর ব্যক্তিজীবন একদিকে টালমাটাল, তার ওপর চেইন মামলার অভিযোগকারীর মেয়ে আত্মহত্যার দায়টাও পড়ে তার কাঁধেই। এতে হরিশঙ্করের মাথার ওপর ঝুলতে থাকে নতুন নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। সব মিলিয়ে তার জীবনে এলোমেলো ঝড় বইতে থাকে!
তাহলে কি সোনার চেইন জালিয়াতির তদন্ত কার্যক্রম এখানেই থেমে যাবে? একের পর এক গুরুতর অপরাধ যে সামনে আসছিল, সেটার কী হবে? অভিযোগকারীর মেয়ের আত্মহত্যার সঙ্গে হরির মেয়ের আত্মহত্যার কি কোনো যোগসূত্র আছে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো রহস্য? বিধ্বস্ত হরির পক্ষে কি জট খোলা সম্ভব?
মাথায় এমন সব প্রশ্ন জমা হতে হতে হতে কখন যে সিনেমার অর্ধেকটা পেরিয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। আর বাকি অর্ধেকটা চলে যায় এ গোলকধাঁধার রহস্য উন্মোচনে।
থ্রিলার নিয়মিত দেখেন, এমন অনেক দর্শকের কাছে গল্প বলার ধরনটা পরিচিত মনে হতে পারে। তবে চেনা আর পরিচিত গল্পের বিন্যাসও যে ভিন্ন স্বাদ দিতে পারে, শাহী কবিরের চিত্রনাট্য পর্দায় দারুণভাবে উপস্থাপন করে সেটাই দেখিয়েছেন জিতু আশরাফ।
মালায়ালাম থ্রিলারের ‘চিরাচরিত’ নিয়মানুযায়ী গল্পে ঢুকতে বেশ সময় লাগে। এক্ষেত্রে চেনা পথে হাঁটেননি জিতু। শুরুতেই দর্শকদের বড়সড় ধাক্কা দিয়ে গল্পের শুরু, সে ধাক্কা হজম করার আগেই মেট্রোর গতিতে ছুটতে থাকে কাহিনি। সে গল্পে রোমাঞ্চের সঙ্গে কমার্শিয়াল সিনেমার অন্য সব উপাদানও দারুণভাবে যোগ করেছেন জিতু। ছিল পর্যাপ্ত অ্যাকশন দৃশ্য, যা সচরাচর এ ধরনের থ্রিলারে দেখা যায় না। বিশেষ করে হাসপাতালে মারামারির দৃশ্যের চিত্রায়ণ ছিল দুর্দান্ত।
চিত্রনাট্যে সমালোচনার যে জায়গা নেই, এমনটা নয়। প্রথমার্ধে যে গতিতে গল্প এগিয়েছে, সেটা আর দ্বিতীয়ার্ধে ধরে রাখা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে গল্প হয়ে পড়ে অনুমেয়। তবে বোবানের অভিনয়, ভার্গিস রাজের সিনেমাটোগ্রাফি এবং জেক্স বিজয়ের আবহসঙ্গীত উত্তেজনার গ্রাফকে খুব একটা নিচে নামতে দেয়নি। এর বাইরে ক্লাইম্যাক্সেও বড়সড় চমক দিয়েছেন জিতু আশরাফ।
অভিনয়ে কানচাকো বোবান ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ব্যক্তিজীবনে বিপর্যস্ত পুলিশ অফিসারের চরিত্রে বেশ কিছু শেড ছিল। রাগ-ক্ষোভ-হতাশার প্রকাশ থেকে শুরু করে বুদ্ধিদীপ্ত পুলিশ অফিসার—সব জায়গাতেই সাবলীল ছিলেন তুখোড় এ অভিনেতা।
গীতা চরিত্রে প্রিয়ামনির স্ক্রিন প্রেজেন্স খুব বেশি না থাকলেও, যতটুকু সময় তিনি সুযোগ পেয়েছেন, হতাশ করেননি। চমকে দিয়েছেন মাদকাসক্ত গ্যাংয়ের সদস্যদের চরিত্রে অভিনয় করা প্রত্যেকেই। তাদের চোখে–মুখে যে হিংস্রতা-ক্ষোভ, সেটা দর্শকদের শরীরে কাটা ধরাবে অনায়াসেই। ক্রিস্টি-আন্না লুইস কিংবা ল্যান্সের মতো চরিত্রগুলো দিয়ে গ্যাং সংস্কৃতিকে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক।
সব মিলিয়ে বলতে গেলে, প্রথমবারের মতো পরিচালনার পরীক্ষায় বসে লেটার মার্কস নিয়ে পাস করেছেন জিতু। বানিয়েছেন বছরের অন্যতম সেরা থ্রিলার। দর্শক যে সেই থ্রিলারে বুঁদ হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে বক্স অফিসেও। ১২ কোটি রূপি বাজেটের সিনেমা এরই মধ্যে ব্যবসা করেছে ৫০ কোটির বেশি! আয়-ব্যয়ের হিসাব একপাশে সরিয়ে রাখলেও বলতেই হয় যে, এক বসাতে শেষ করার মতো একটি সিনেমা উপহার দিয়েছেন জিতু।
রেটিং: ৪.৪৫/ ৫.০০
পরিচালক: জিতু আশরাফ
চিত্রনাট্য: শাহী কবির
অভিনয়শিল্পী: কানচাকো বোবান, ভিশাক নাইর, জগদিস, প্রিয়ামনি, বৈশাখ শঙ্কর, বিষ্ণু জি ভারিয়ের, লিয়া মামেন, ঐশ্বরিয়া রাজ, অমিত ইয়াপেন প্রমুখ।
ধরন: ক্রাইম, থ্রিলার
ভাষা: মালায়ালাম
মুক্তি: ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (নেটফ্লিক্সে ২০ মার্চ, ২০২৫)