বাংলা চলচ্চিত্রে সালমান শাহ এক ইতিহাস। পর্দায় তাঁর অভিনয়ে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন দর্শক, তেমনি অল্প বয়সেই এই অভিনেতার মৃত্যু তাঁদের কাঁদিয়েছে, করেছে বিস্মিত। কেউ বলেন, আত্মহত্যা করেছেন নায়ক! আবার কারও মতে, পরিকল্পিতভাবে হত্যাকাণ্ড। ভক্তদের কাছে সেই রহস্য আজও অধরাই থেকে গেল।
সালমান শাহের মা নীলা চৌধুরী, অনুরাগী ও স্বজনরা এই মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে মানতে নারাজ। আজ ২৮ বছর হয়ে গেল বিচারের অপেক্ষায় তাঁরা। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের পরও কাটছে না জটিলতা। আদালতে চলছে আইনি লড়াই।
আজ ৬ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্রের রাজপুত্র চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার ইমন ওরফে সালমান শাহর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯৯৬ সালেও এই দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল ৭টায় সালমান শাহর সঙ্গে দেখা করতে ইস্কাটনের বাসায় যান তাঁর বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু তিনি ছেলের দেখা পাননি। অবশেষে ফিরে যান।
সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী জানান, বাসার নিচে দারোয়ান তাঁর বাবাকে ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছিল না। তিনি বলেন, ‘বলেছে স্যার এখনতো উপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহর স্ত্রী) জিজ্ঞেস করতে হবে। এক পর্যায়ে উনি (সালমান শাহর বাবা) জোর করে উপরে গেছেন। কলিং বেল দেবার পর দরজা খুললো সামিরা (সালমান শাহর স্ত্রী)।’
যোগ করে নীলা চৌধুরী বলেন, ‘উনি (সালমান শাহর বাবা) সামিরাকে বললেন ইমনের সাথে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাকো। তখন সামিরা বললো, আব্বা ওতো ঘুমে। তখন উনি বললেন, ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি। কিন্তু যেতে দেয় নাই। আমার হাজব্যান্ড প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।’
এরপর এদিন সকাল ১১টার দিকে মা নীলা চৌধুরীর কাছে একটি টেলিফোন কল আসে। তাঁকে বলা হয়, সালমান শাহকে দেখতে হলে এখনই যেতে হবে। ফোন পেয়ে দ্রুত ছেলের বাসার দিকে রওনা দেন তিনি। ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলেকে তিনি বিছানার পড়ে থাকতে দেখতে পান।
নীলা চৌধুরী বলেন, ‘খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেবার কথা সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেবার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার এক আত্মীয়ের একটি পার্লার ছিল। সে পার্লারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে সর্ষের তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট (অজ্ঞান) হয়ে গেছে।’
এ সময় সালমানকে কেমন দেখেছিলেন সেই বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম আমার ছেলের হাত-পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে।’
এরপর দ্রুত ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে জানানো হয়, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন।
সালমান শাহ অভিনীত প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’র শেষ দৃশ্যের মতো তাঁর জীবনও থেমে গিয়েছিল এর ঠিক চার বছর পর। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, আত্মহত্যা নয়, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে।
নীলা চৌধুরীর অভিযোগ করেছিলেন, এ ঘটনায় থানায় তাঁরা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে এটি হত্যাকাণ্ড, তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা হত্যা মামলায় মোড় নেবে।
সালমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে না পারায় তাঁর ভক্তদের মাঝে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের। দেশজুড়ে তাঁর অসংখ্য ভক্ত এ মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। এমনকি এতে বেশ কয়েকজন তরুণীও আত্মহত্যা করেছে বলেও তখনকার পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।
প্রসঙ্গত, চলচ্চিত্রে তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন সালমান শাহ। তাঁর অভিনীত সিনেমার মধ্যে ‘সুজন সখি’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘মহামিলন’, ‘বিচার হবে’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘জীবন সংসার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘আনন্দ অশ্রু’, ‘বুকের ভিতর আগুন’ উল্লেখযোগ্য। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ক্যারিয়ারে তিনি ২৭টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।