‘ডাস্টবিনে মিলল নবজাতক’, ‘নবজাতকের মরদেহ পড়েছিল ডাস্টবিনে’, ‘নবজাতকের পৃথিবী ডাস্টবিনে’—পত্রিকার পাতা কিংবা অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রায়ই এ ধরনের সংবাদে চোখ আটকে যায়। সেসব প্রতিবেদন পড়েও শিউরে উঠতে হয়! কী ভয়াবহ! পৃথিবীতে আসতে না আসতেই কিনা স্নেহের বদলে নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হলো একটি শিশু!
ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া এম রাহিম পরিচালিত ‘জংলি’র কাহিনি এমন হৃদয়বিদারক একটি ঘটনাকে ইঙ্গিত করে আবর্তিত হয়েছে। তবে গল্পের ডালপালা ছড়িয়েছে আরও নানাদিকে, নানামাত্রায়।
সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এ সিনেমায় সিয়াম আহমেদ রয়েছেন ‘জনি’ চরিত্রে, যে কিনা অল্প বয়সেই এক দুর্ঘটনায় চোখের সামনে তার মাকে জীবন্ত পুড়ে মরতে দেখেছে। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বাবা, কিন্তু সেই বাবার সঙ্গেও সম্পর্কে টানাপোড়েন। এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে নূপুর নামের এক মেয়ের প্রেমে পড়ে সে, সেখানেও ছলনার শিকার হয়। শেষমেশ একবুক হতাশা আর অভিমান বুকে জড়িয়ে সব ছেড়েছুড়ে জনি পাড়ি দেয় অজানা-অনিশ্চিত এক গন্তব্যে। সঙ্গে স্মৃতি হিসেবে থেকে যায় তার মায়ের একটি ছবি ও নিজের প্রিয় মোটরসাইকেলটি। জনির এই দিশেহারা, এলোমেলো, নিঃসঙ্গ জীবনে আলো হয়ে আসে ছোট্ট একটি মেয়ে, যার নাম ‘পাখি’। ছোট্ট মেয়েটিও পথশিশু, যে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ঘটনাক্রমে হারিয়ে গিয়েছে। সবহারা জনির কাছে পাখি তার মেয়ের মতো বেড়ে উঠে। কোষের ‘পাওয়ারহাউজ’ যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া, তেমনি সন্তানের কাছে প্রতিটি বাবা-মা যে রীতিমতো ‘পাওয়ারহাউজ’, দর্শকদের সেই কথা মনে করিয়ে দেয় জংলি।
পর্দায় জনি আর পাখির এই গল্প শোনায় তিথি নামের এক ডাক্তার। এই ‘তিথি’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শবনম বুবলী।
সিনেমাটিতে সিয়াম আহমেদকে যেমন শহুরে ছেলে হিসেবে দেখা যায়, তেমনি সবহারানো জীবনে তাঁকে দেখা যায় বড় দাড়ি-গোঁফ আর জীর্ণ পোশাকআশাকে। এমন একটি পাগলপ্রায় চরিত্র ঠিকঠাক ফুটিয়ে তুলেছেন এই অভিনেতা। গোটা সিনেমায় বেশ স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন সিয়াম।
কিংবদন্তি নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামি এক সাক্ষাৎকারে শিশুদের অভিনয় প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘শিশুদের সঙ্গে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার পর, আমি বুঝতে পেরেছি যে তারা কতটা সুন্দর ও সহজ-সরল, এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি সঠিক ও আকর্ষণীয়।’
জংলি চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী নৈঋতা হাসিন রৌদ্রময়ীর অভিনয় দেখতে গিয়ে আব্বাস কিয়ারোস্তামির এই কথাগুলো মনে পড়ে। এম রাহিমও পাখি চরিত্রটি বেশ চঞ্চলমতী রূপে উপস্থাপন করেছেন। দর্শক তার কথায় কখনও হেসেছেন, কখনোবা তার জন্য চোখের জল ফেলেছেন। গোটা সিনেমায় নৈঋতার অভিনয় ছিল বেশ সাবলীল।
অন্যদিকে, এ সিনেমার মতো সাদাসিধে চরিত্রে শবনম বুবলীকে খুব কমই দেখা গেছে! অভিনয়ে তিনিও ছিলেন সাবলীল। একটি চরিত্রে রয়েছেন অভিনেতা সোহেল খান। পর্দায় তাঁর উপস্থিতি ছিল দর্শকের জন্য বাড়তি পাওনা। আর ‘নুপূর’ চরিত্রে প্রার্থনা ফারদিন দীঘিও দুর্দান্ত। ক্রাইম জার্নালিস্ট চরিত্রে রাশেদ মামুন অপুর পারফরম্যান্স অনবদ্য। এ ছাড়া দিলারা জামান, শহীদুজ্জামান সেলিম, সুব্রত ছিলেন বরাবরের মতোই সাবলীল।
জংলি’র সিনেমাটোগ্রাফি মনোমুগ্ধকর। কখনও কখনও যদিও লোকেশনের ধারাবাহিকতা বজায়ে কিছুটা ছেদ পড়েছে! এই দিকে নির্মাতার একটু খেয়াল রাখা দরকার ছিল। তবে সিনেমাটির গান আর সংলাপ বেশ হৃদয়ছোঁয়া। বিশেষ করে কৃষ্ণেন্দু ও কৌশিকির কণ্ঠে ‘বাবা তোমায় ছাড়া’ গানটি দর্শকদের আপ্লুত করে।
সব মিলিয়ে, জংলি সিনেমার গল্পটি বেশ আবেগ আর ভালোবাসাময়। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তেমনি সন্তানের যত্ন কিংবা দায়িত্ব নেওয়াও বাবা-মায়ের সহজাত কর্তব্য—এই বিষয়টিই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন নির্মাতা এম রাহিম।