‘অন্যরা তোমাকে যাই বলুক বা বোঝানোর চেষ্টা করুক না কেন, আসলে গন্তব্যই সত্য, যাত্রা নয়’—সিনেমার একেবারে শেষের একটি সংলাপ। যে চরিত্রটি এই সংলাপ দেয়, তার জীবনে উত্থান–পতন প্রচুর। শৈশবে চলে গেছে মা। হ্যাঁ, একেবারেই। বাবার প্রসঙ্গই ওঠে না। এক নিকটাত্মীয় পরিবারে বেড়ে ওঠা। তাও একেক দেশে আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে শেষে এক ভূখণ্ডে গিয়ে ঠাঁই পাওয়ার চেষ্টা। জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় পার হয়ে যখন মামাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে এক প্রদর্শনীতে কথা বলার সুযোগ আসে, তখন এই কথাই তার মুখ দিয়ে বের হয়। সেই সঙ্গে সিনেমার সাথে পুরোটা গল্পে ঘুরে বেড়ানো মনযোগী দর্শকও মাথা দোলাতে বাধ্য হয়। কারণ এই সিনেমা দেখার পর হাজার হাজার জ্ঞানীর যাত্রা উপভোগের বাণী একেবারেই ঠুনকো লাগে যে!
আসলে জীবনকে একটি যাত্রার সঙ্গে তুলনা করা হয় হামেশাই। অনেক জ্ঞানী–গুণী ব্যক্তিরাই বলে থাকেন যে, যাত্রা (সে জীবন বা ক্যারিয়ার, যাই হোক না কেন) উপভোগ করা উচিত। তাতেই মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন, গন্তব্যকে উহ্য রেখে। বরং এই যাত্রাকালের সময়টাতে নিস্পৃহভাবে কাজ করে যাওয়ার নসিহতই পাওয়া যায় সব সময়। অথচ বেশির ভাগ মানুষের জন্য গন্তব্যই বাস্তবতা। ওখানে পৌঁছানোটাই সব, কীভাবে পৌঁছাতে হবে—সেটি কোনো বিষয় নয়। আর অভিবাসী বা উদ্বাস্তু হয়ে পথে পথে ঘোরাদের ক্ষেত্রে তা যেন আরও কঠিন সত্য।
এই সত্য কথনই দিয়েছে ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’। এই সিনেমাটি আসছে অস্কার আসরের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন মার্কিন নির্মাতা ব্র্যাডি করবেট। নির্মিত হয়েছে হাঙ্গেরীয়-ইহুদি গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তির ও তার পরিবারের আমেরিকায় পাড়ি জমানো এবং সেখানে তাঁর টিকে থাকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। সেরা ছবি ছাড়াও সিনেমাটি সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা (অ্যাড্রিয়েন ব্রডি), সেরা পার্শ্ব অভিনেতা (গাই পিয়ার্স), সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী (ফেলিসিটি জোন্স), সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য, সেরা মৌলিক সুর, সেরা সিনেমাটোগ্রাফি, সেরা এডিটিং ও সেরা প্রোডাকশন ডিজাইন বিভাগে অস্কার মনোনয়ন পেয়েছে।
প্রায় ৩ ঘন্টা ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের দীর্ঘ এক সিনেমা ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’। সাধারণত এত দীর্ঘ সিনেমা হলিউডে খুব হাতেগোণা। সেই ছোট্ট তালিকায় ঢুকে যাওয়ার পাশাপাশি সমালোচক থেকে সাধারণ দর্শকদের মনও জয় করেছে ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’। সিনেমা হলে মুক্তির পর ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অ্যাপল টিভি প্লাসেও দেখা যাচ্ছে ছবিটি।
গল্পের শুরুতেই পুরো উল্টো হয়ে দেখা দেয় আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি। শেষটায় অবশ্য এই উল্টো স্ট্যাচু অব লিবার্টি আক্ষরিক অর্থেই ধরা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হাঙ্গেরীয়-ইহুদি লাজলো টট আমেরিকায় সূর্যের আলো দেখার পরক্ষণেই উল্টো স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে। জীবনটাকে গড়ে তোলার একটা নতুন সুযোগ হিসেবেই সে নিতে চেয়েছিল একে। তখনও লাজলো জানে না, তার স্ত্রী ও ভাগ্নি বেঁচে আছে কিনা। শুধু একটা আশা ছিল মনে, হয়তো আছে বেঁচে। এমন পরিস্থিতিতেও নিজের জীবন বাঁচানোর একটা আশায় বুক বাঁধতে চেয়েছিল তরুণ স্থপতি লাজলো। আর যখন ভাইসূত্রে জানতে পারল যে, স্ত্রী ও ভাগ্নি এখনও শ্বাস নিচ্ছে, তখন নিজের পাশাপাশি আরও দুটো জীবনকে টিকিয়ে রাখার সংকল্পে বাঁধা পড়ল লাজলো।
শুরু হলো সংগ্রামের জীবন, যেখানে টিকে থাকার স্বার্থেই ক্যাথলিক বনে যাওয়ার চাপ অনেক। কারণ আমেরিকায় ভিনদেশি অভিবাসীদের খুব একটা আদরে রাখা হয় না যে।
তাই নিজের পেট ভরানোর জন্য অভুক্তদের লাইনে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আরও দুটি মানুষকে নিজের কাছে আনার দায়িত্ব বোধ করে লাজলো। শুরুটা এক ভাইয়ের ফার্নিচারের দোকানে চাকরি নিয়ে। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান এলে তার দায় মাথায় নিয়েই সেই আশ্রয় কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়তে হয় লাজলো’কে। সাথে উপরি হিসেবে আসে গঞ্জনাও। আর্কিটেক্ট থেকে একেবারে দিনমজুর হতে হয়। গায়ে–গতরে খেটে জীবন চালানোর ওই সময়েই এক ধনাঢ্য ব্যক্তির নজরে পড়ে লাজলো। সেই সুযোগেই ফের উঠে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে এক হওয়ার দুরাশাও একটু একটু করে আশার আলো দেখতে পায় যেন।
‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ নিয়ে দ্য গার্ডিয়ানের ভাষ্য হলো, ‘এটি শক্তিশালী গল্পের রোমাঞ্চকর পরিচালনা। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র, যা এর প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার চলমান সময়কে নিশ্চিতভাবে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়।’ হ্যাঁ, এটি ঠিক যে, এই সিনেমার দৈর্ঘ্যের দিক থেকে দর্শকদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিলেও, সেটি কখনোই আফসোসের জন্ম দেয় না। বরং সিনেমার মতো করেই যে কোনো দর্শক দেখা শেষের পর লাজলো টট–এর কথা ভেবে দুঃখবোধ করবেন। সেই সঙ্গে হয়তো নিজেকেও এই প্রশ্ন করবেন যে, ‘এই বিশাল দুনিয়ায় আমিও কি লাজলোর মতোই? গন্তব্যই কি শুধু একমাত্র লক্ষ্য?’
সিনেমার প্রধান চরিত্র লাজলো টট হিসেবে পর্দায় ছিলেন অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। এ অভিনেতা ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ হিসেবে খ্যাত। সেই পিয়ানিস্ট এবার ব্রুটালিস্ট—তাঁকে ঠেকায় সাধ্য কার! ওদিকে অ্যাড্রিয়েন ব্রডিকে যোগ্য তাল দিয়ে গেছেন ধনাঢ্য ব্যক্তির চরিত্রে থাকা গাই পিয়ার্স। তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, মাঝে মাঝে অ্যাড্রিয়েন ব্রডিও ফিকে হয়ে যাচ্ছিলেন। সিনেমার দ্বিতীয় ভাগে লাজলোর স্ত্রীর ভূমিকায় পর্দায় আসেন ফেলিসিটি জোনস। অথচ পর্দায় আসার পর পরই এক লহমায় সব মনযোগ কেড়ে নেন যেন। চরিত্রটি একজন চলৎশক্তিহীন স্ত্রী’র, যে কিনা সঙ্গীর ভঙ্গুর মুহূর্তে ঠিকই উঠে দাঁড়ায়। সেই ঋজু চাহনিকে সহ্য করা তখন অসম্ভব এক কাজ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে ধর্ষকের পক্ষে তো বটেই।
সিনেম্যাটোগ্রাফি ও আবহ সংগীতের ব্যবহারেও এগিয়ে থাকবে ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’। আবার শুরুর উল্টো হয়ে পর্দায় আসা স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো করেই সিনেমার শেষে ক্রেডিট লাইনও আসে ঈষৎ বাঁকা হয়ে। তাতে যেন লিবার্টির উল্টো ন্যারেটিভই আরও সত্য হয়ে ধরা দেয়।
এক কথায়, ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ এক অসহায় অভিবাসীর অনুপম জীবন অভিজ্ঞতা। দুনিয়ার কোমল, সুন্দর রূপের বিপরীতে ঠিক যেন আরেক কর্কশ ও নিষ্ঠুর চেহারাকে পর্দায় তুলে আনা হয়েছে। তাতে প্রতারণা আছে, হোঁচট খাওয়া আছে, আর আছে আশায় বুক বেঁধেও তা চুরমার হয়ে যাওয়ার কান্না!