এখন বিশ্বায়নের যুগ। বাকস্বাধীনতার সময়। সাথে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের রমরমা বাণিজ্যে পুরো দুনিয়াই হয়ে গেছে মতামত দেওয়ার উর্বর স্থান। তবে এক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার চেয়ে বিচার করাটাই কি বেশি হয় না? হ্যাঁ, হয়। এর পরিমাণও বরং বেশি। এবং একেকজনের একেক কাঠগড়ায় দোষী হয় ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। কখনো আবার আবছাভাবে ঘটনা জেনেই আমরা একজনের উপরই উগড়ে দিই নিজেদের বিচার। সেই বিচারে অন্য কারও হয়তো জীবন ধারণ করাই হয়ে ওঠে দস্তুর!
ঠিক তখনই কেউ চিৎকার করে বলে ওঠে—‘আপনারা ইতরের মতো এই চিৎকার থামান!’
ইতর বলাতে খুব খারাপ লাগছে কি? নিজেকে মনে হচ্ছে? কিন্তু এমনতর কাজ আমরাই করি। আমার আশপাশের মানুষেরাও করে। এভাবেই একটি কর্কশ সমাজ গড়ে ওঠে। আর তেমনই একটি সামাজিক ব্যবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তোলে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। মাঝখানের সত্যিটা আবছা হয়েও যায় মাঝে মাঝে। যদিও তখন সত্যি বলে আসলেও যে কিছু আছে, তা নিয়েও যে সংশয় উঠে যায়!
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ মুক্তি পেয়েছে চলতি বছরের শুরুতে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই সিনেমাটি প্রথমে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই’তে দেখা যাচ্ছে ১৮ বছরের বেশি বয়সী দর্শকদের জন্য উপযোগী সিনেমাটি।
‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ একটি লিগ্যাল থ্রিলার। এই ঘরানার সিনেমাটির গল্প সম্পর্কে হইচই বলেছে, ‘এক কিশোরের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ। বারোজন জুরি সদস্যের হাতেই তার ভাগ্য। রায় প্রথমে সহজ মনে হলেও, একজন সদস্যের সন্দেহ জাগিয়ে তোলে বাকিদের বিবেক। যুক্তি-তর্কের মাঝে খুলে যায় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত স্মৃতি, লুকোনো সত্য, আর নৈতিক দ্বন্দ্বের পরত।’
গল্প সম্পর্কে শুনে কিছুটা ধারণা নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। খুব দ্রুতই এই জুরি সদস্যদের চালানো বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এর পরেই আসলে মূল কাহিনীর সঙ্গে সমান্তরালে চলতে থাকে ছোট ছোট আরও কিছু গল্প। একটু একটু করে বের হয়ে আসে কোন জুরির কীসে অ্যালার্জি, আর কীসেই’বা ট্রমা!
১২৬ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার শুরুতেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, ‘এক রুকা হুয়া ফাইসলা’ নামের হিন্দি ছবি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়া বাসু চ্যাটার্জি পরিচালিত এই সিনেমাটি আবার ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া হলিউডের সিনেমা ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’ অবলম্বনে তৈরি। নির্মাতার পক্ষ থেকে অবশ্য কেবল ‘এক রুকা হুয়া ফয়সালা’ সম্পর্কিত দায় স্বীকারই করা হয়েছে। ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’–এর উল্লেখ থাকলেও খারাপ হতো না। তাতে অন্তত শেকড়ের প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হতো। অবশ্য এটি পুরোপুরিই নির্মাতার বিষয়। তিনি নিশ্চয়ই ‘এক রুকা হুয়া ফয়সালা’ দিয়েই অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সেটি হতেই পারেন বটে।
ইতিহাসের কচকচানি বাদ দিলে বলতেই হয়, কাঠামো এক হলেও ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’ কনটেন্টের দিক থেকে মৌলিক অবশ্যই। এর কারণ, এতে সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়কে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়। কাঠামো এক রেখেও তাতে জুড়ে দিয়েছেন ভিন্ন রক্ত–মাংস। এতে চেহারাটাও হয়েছে অনেকটা ভিন্ন। জুরিদের যুক্তি–তর্কের খাতিরেই উঠে এসেছে এমন সব ইস্যু, যা ভারত–পাকিস্তান–বাংলাদেশ—সব দেশের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। আমরা ধর্ম নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, নিজেদের বিশ্বাস–অবিশ্বাস ও কুযুক্তি নিয়ে যে খেলাধুলা করছি কেবলই নিজেদের স্বার্থের বা ট্রমার খাতিরে, সেটি এতটা স্পষ্টভাবে বাংলা কোনো সিনেমায় অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। আমাদের দেশে আমরা সবাই জুরি, যে যার মতো বিচার করে চলেছি। সেই বিচারে কে বলি হলো, তাতে কার কি এসে গেল!
সীমাবদ্ধ সময়ের সীমার মধ্যে যেভাবে ঠিক এমন একটি কর্কশ সমাজের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে, তা এক শব্দে ‘অনবদ্য’। এতে পরিচালকের সাধুবাদ প্রাপ্য। সাম্প্রতিক সময়ে এটি সৃজিতের অন্যতম ভালো কাজ। বিশেষ করে, এত ভালো ভালো অভিনয়শিল্পীদের পরিচালক হিসেবে সামলানোও চাট্টিখানি কথা নয়।
অভিনয়ের প্রসঙ্গ যখন এলোই, তখন বলতেই হয় যে, পুরো সিনেমাতে অভিনয়ের দিক থেকে বিচ্যুতি দেখাই যায় না। চরিত্রের সংলাপ থেকে ধার করে বলা যায়, একেবারে ‘ক্লিনিক্যাল’। শিল্পীদের নামগুলো হলো: কৌশিক গাঙ্গুলি, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনির্বান চক্রবর্তী, অনন্যা চ্যাটার্জী, ঋত্বিক চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, অর্জুন চক্রবর্তী, রাহুল অরুণোদয় ব্যানার্জী, সৌরসেনী মৈত্র, সুহোত্র মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী চ্যাটার্জী, কাঞ্চন মল্লিক প্রমুখ। এবার আপনারাই বলুন, পর্দায় কাকে ছেড়ে কার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যায়! এবং স্ক্রিন প্রেজেন্সে অভিনয়শিল্পীরাও এমন প্রতিযোগীতায় নেমেছিলেন বৈকি। কখনো কৌশিক গাঙ্গুলি দর্শকদের সব মনযোগ কেড়ে নিচ্ছেন, তো পরক্ষণেই পরমব্রত তাঁর যুক্তির তরবারি দিয়ে চোখে (কিংবা মস্তিষ্কে) বুলিয়ে দিচ্ছেন পেলব স্পর্শ।
ওদিকে ঋত্বিক ও অনির্বান এমন শৈলী প্রদর্শন করেছেন যে, কখনো মনেই হয় না তাঁরা তাঁদের চরিত্রের বাইরের কোনো মানুষ হতে পারেন। মানসিকভাবে সৌরসেনীর ভেঙে পড়ার দৃশ্যটি দেখলে চোখের কোণে একটু হলেও জল জমে। আর হাজারো খিটিমিটি সত্বেও অনন্যা যখন সহমর্মী হয়ে তাঁকে সেই ভেঙে পড়ার মুহূর্তে জড়িয়ে ধরেন, তখন মনে হয়, আমাদের সবার তো এমনই হওয়ার কথা ছিল, তাই না!
কিন্তু সত্যিটা হলো, আমরা এমন নই। আর সে কারণেই আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’। এটিই তো তেমন এক আয়না, যাতে আমরা নিজেদের চিনতে পারি। বুঝতে পারি কোথায়, কী অবস্থায় আছে আমাদের মন ও মনন। নিজেদের কিছুটা চেনার জন্য হলেও তাই দেখাই উচিত ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’।
রেটিং: ৪.৫৫ / ৫.০০