একজন মানুষ পড়ে আছে খাদে। শীতল আবহাওয়ায় ঝরছে পেঁজা তুলোর মতো তুষার। তাতে প্রায় ঢেকে গেছে মানুষটির পুরো শরীর। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই তার মাথায় গেঁড়ে বসে উদ্ধার পাওয়ার চিন্তা। অথচ তার নড়াচড়ার উপায় খুব একটা নেই। এমন সময় দেবদূত হয়ে যেন দেখা দেয় আরেকজন, খাদের উপরে। তা দেখে পড়ে থাকা মানুষটি ভাবে, যাক উদ্ধার পাওয়া গেল বুঝি!
কিন্তু ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া মানুষটি যে পড়ে থাকা আরেক মনুষ্য সন্তানকে উদ্ধার করতে আসেনি। বরং রক্ত–মাংসের মানুষের চেয়ে তার কাছে অস্ত্র বেশি দামী। তাই অস্ত্র নিয়ে গেলেও, পড়ে থাকা আহত মানুষ উদ্ধারে কোনও আগ্রহ থাকে না তার। শুধু থাকে একটি জিজ্ঞাসা—‘আচ্ছা, বলো তো, মরে গেলে কেমন লাগে?’
এভাবেই শুরু হয় ‘মিকি সেভেন্টিন’। গেল মাসেই সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে আমেরিকায়। তার কিছুদিন আগে অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়াতেও মুক্তি পেয়েছিল। একেবারেই সাম্প্রতিককালের সিনেমা ‘মিকি সেভেন্টিন’। এখন অবশ্য অ্যাপল টিভি প্লাসেও দেখা যাচ্ছে ২ ঘন্টা ১৭ মিনিটের এই সাই–ফাই ব্ল্যাক কমেডি ঘরানার সিনেমাটি।
ছবিটির পরিচালক বং জুন হো। দক্ষিণ কোরিয়ার এই নির্মাতা বিখ্যাত ‘প্যারাসাইট’ নামের সিনেমার জন্য। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্যারাসাইট’ আলোড়ন তুলেছিল সারা দুনিয়ায়। সাড়ে এগারো মিলিয়ন ডলারে তৈরি সিনেমাটি বিশ্বজুড়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যবসা করেছি। শুধু ভালো ব্যবসা নয়, সমালোচকদেরও মন জয় করেছিল ‘প্যারাসাইট’, ৯২তম অস্কারের আসরে জিতেছিল সেরা ছবির তকমা। তো, এহেন বং জুন হো যখন নতুন সিনেমা ‘মিকি সেভেন্টিন’ নিয়ে হাজির হন, তখন আগ্রহের পারদ তুঙ্গে থাকে বৈকি।
এখন বরং সিনেমার কাহিনি সম্পর্কে কিছুটা বলা যাক। সেক্ষেত্রে লেখার শুরুতে বর্ণিত দৃশ্যের সাথে কিছুটা যোগাযোগও স্থাপন করা সম্ভব হবে। ‘মিকি সেভেন্টিন’ বলে ২০৫০ সালের পৃথিবীর গল্প। তাতে মিকি বার্নস প্রধান চরিত্র। মিকি দেনায় আকণ্ঠ ডুবে থাকা একজন মানুষ। কোনোভাবে এদিক, সেদিক কাজ করে জীবন চালায়। বেশ কিছুদিন ধরেই এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছিল মিকি। পারলে দুনিয়া ছেড়ে দেয় এমন অবস্থা। শেষে পাওয়া গেল অদ্ভুত এক সুযোগ। নিফলহাইম নামের নতুন এক গ্রহে মানুষের কলোনি বসাতে চায় এক ধনী রাজনীতিবিদ কেনেথ মার্শাল। সেই স্পেসশিপেই জায়গা হয় মিকির, এক্সপেন্ডেবল হিসেবে। এরপরই শুরু হয় মিকির অন্য জীবন।
প্রশ্ন আসে, এক্সপেন্ডেবল কি? সিনেমার কাহিনি বলে, এ হলো খরচযোগ্য জীবনের মানুষ। খুবই উন্নত প্রযুক্তির বদৌলতে বিজ্ঞানীরা যেহেতু মানুষের কপি বা ক্লোন তৈরি করতে শিখে গেছে, তাই বিভিন্ন মহাকাশযাত্রায় এক্সপেন্ডেবল রাখা হচ্ছে। এ কাজে নিয়োজিত মানুষকে নানা বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে ও পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হয় গিনিপিগ হিসেবে। ধরা যাক, নতুন গ্রহে থাকা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গবেষণার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে এক্সপেন্ডেবলকে সেই জীবাণুতে আক্রান্ত হতে দেওয়া হবে ইচ্ছাকৃতভাবে, তার ওপর পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলবে নতুন ওষুধের। মরেও যেতে পারে এক্সপেন্ডেবল। তবে তাতেও ক্ষতি নেই। আরেকবার প্রিন্ট করে নিলেই হলো!
অনেকটা না বুঝেই এক্সপেন্ডেবলের খাতায় নাম লেখায় মিকি। ১, ২, ৩—এভাবে ১৬টি মিকির আবির্ভাবও হয়। ঝামেলা হয়, যখন লেখার শুরুতে থাকা দৃশ্যে ১৭ নম্বর মিকির মৃত্যু হয় না। ওদিকে ভুল করে ১৮ নম্বর মিকিও তৈরি হয়ে গেছে। এরপরেই শুরু হয় আসল কাহিনি। পুরোপুরি বিপরীত স্বভাবের ১৭ ও ১৮ নম্বর মিকির অবস্থা নিয়ে এগোতে থাকে গল্প।
এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন রবার্ট প্যাটিনসন, মার্ক রাফেলো, নাওমি অ্যাকি, স্টিভেন ইউন প্রমুখ। মিকি চরিত্রে ছিলেন রবার্ট প্যাটিনসন। এক শব্দে বললে, দারুণ অভিনয় করেছেন তিনি। বিশেষ করে, দুই মিকির চারিত্রিক ভিন্নতা যেভাবে শরীরী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন রবার্ট প্যাটিনসন, তাতে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। ধনী রাজনীতিবিদের চরিত্রে মার্ক রাফেলো ছিলেন পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য। মার্কের এই চরিত্রায়ন দেখে যে কারও বর্তমান বিশ্বে পরিচিত এমনতর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিক। এক কথায়, একেবারেই নিখুঁত ছিলেন হলিউডের এই গুণী অভিনেতা। এর বাইরে অন্যান্য প্রধান, অপ্রধান চরিত্রে রূপদানকারী অভিনয়শিল্পীরা এতটাই ভারসাম্যপূর্ণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন যে, দর্শক হিসেবে তেমন বেমানান বোধ হয়নি খুব একটা।
‘মিকি সেভেন্টিন’ সিনেমায় পরিচালক বং জুন হো ভবিষ্যতের ক্যানভাসে এঁকেছেন এমন এক দুনিয়ার ছবি, যেখানে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হয়েছে প্রকটভাবে। এক মানুষই আরেক মানুষকে শোষণ করছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। মানুষের দাম মানুষের কাছেই এতটা কমে গিয়েছে যে, এক্সপেন্ডেবল তকমা দিতেও আপত্তি থাকছে না আর। ওই দুনিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসেবে। উগ্র রাজনৈতিক দর্শনের অনুরাগীও মিলছে অকাতরে। এবার, বলুন তো, এসবের কোন কোন নিদর্শনের ইঙ্গিত এখনকার দুনিয়াতে এখনও দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে না?
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে যে, ‘মিকি সেভেন্টিন’ দিয়ে পরিচালক বেশ স্পষ্টভাবেই রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা দিতে চেয়েছেন। এটি অবশ্য স্বীকারও করেছেন বং জুন হো। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন যে, ‘এই সিনেমার গল্পটি আসলে মিকির একটি যাত্রা, যার মধ্য দিয়ে মিকি ব্যক্তি হিসেবে ফের আত্মমর্যাদা অর্জন করে, মানুষ হিসেবে নিজের সম্মানটাকে ফিরে পায়।’
বক্স অফিসে খুব একটা সুবিধা অবশ্য করতে পারেনি ‘মিকি সেভেন্টিন’। ডিজিটাল রিলিজের আগে বেশ কষ্ট করেই শেষ পর্যন্ত কোনোমতে খরচ তুলতে পেরেছে। তবে পকেট ভর্তি পয়সাই তো দিনশেষে শেষ কথা নয়। আর তার বিরুদ্ধেই যে দাঁড়িয়েছে ‘মিকি সেভেন্টিন’। তাই কোনো সিনেমা দেখে কিছুটা ভাবতে চাইলে, মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে একটু ব্যস্ত করতে চাইলে দেখতেই পারেন এই সিনেমা। সময় নষ্ট হবে না, গ্যারান্টি।
রেটিং: ৪.৬৫ / ৫.০০