সমাজে ছুৎমার্গ থাকে। দেশেও থাকে। কে ছোঁয়ার যোগ্য, আর কে নয়—সেটি বেশির ভাগ সময়ই নির্ধারণ করে দেয় তথাকথিত সমাজ। সেই সমাজের ভিত্তিতে আবার দেশ চলে, চলে মানুষের মনও। এভাবে নির্ধারিত হয় যে, কার স্বপ্ন বাতিলযোগ্য, আর কারটা বাতিল করা চূড়ান্ত অপরাধ! এভাবেই কারও বেখেয়ালও বৈধতা পেয়ে যায়। কারণ বর্তমান দুনিয়ায় যে সম্পদের পরিমাণই ন্যায়–অন্যায়ের লাইসেন্স দেয়।
‘আনোরা’ তেমনই একটা দেশের কথা বলে, একটা সমাজের কথা বলে। সেই সমাজ বা দেশের সাথে আবার দুনিয়ার বাকিসবেরও নানামাত্রিক মিল চাইলেই পাওয়া যায়। হ্যাঁ, বলাই যায় যে, আনোরা একটা ফিকশন দেখিয়েছে, কল্পিত গল্প কেবল। কিন্তু একবার চোখটা বন্ধ করে যদি ভেবে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে, ওই বাস্তবতার বাইরে শুধু আমেরিকা কেন, আসলে কোন দেশ বা সমাজটা আছে।
আজ বাদে কাল বসছে এ বছরের অস্কারের আসর। এবারের আসরের অন্যতম আলোচিত চলচ্চিত্র আনোরা। এই সিনেমাটির ধরন হিসেবে বলা হচ্ছে রোমান্টিক-কমেডি। পরিচালনা করেছেন মার্কিন নির্মাতা শন বেকার। গল্পও লিখেছেন তিনি। চলচ্চিত্রটি এবারের অস্কারে সেরা সিনেমা ছাড়াও সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেত্রী (মাইকি ম্যাডিসন), সেরা পার্শ্ব অভিনেতা (ইউরা বরিসভ), সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য ও সেরা এডিটিং বিভাগে মনোনয়ন লাভ করেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, অস্কার আসর মাতানোর ভালোই সম্ভাবনা আছে এ ছবির।
এমন সম্ভাবনার পক্ষে জোরালো যুক্তি তৈরি করেছে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পাওয়া আনোরার সাফল্যও। সবশেষ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘দ্য ব্রুটালিস্ট’ ও ‘এমিলিয়া পেরেজ’কে পেছনে ফেলে স্বর্ণপাম জিতে নিয়েছিল সিনেমাটি। এমনকি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের করা বর্ষসেরা ছবির তালিকাতেও স্থান পেয়েছিল ‘আনোরা’। একইসঙ্গে বক্স অফিসেও ভালো ব্যবসা করেছে ছবিটি। মাত্র ৬ মিলিয়ন ডলারে তৈরি সিনেমাটি আয় করেছে ৪০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এই সিনেমার গল্প সেই আনোরা’কে নিয়ে, যে কিনা নিজেকে অ্যানি বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করে। আনোরা একজন ২৩ বছর বয়সী স্ট্রিপার, ল্যাপ ড্যান্সার। বাস আমেরিকার নিউইয়র্কে। এক আদিমতম পেশা দিয়ে জীবন চালায় সে। সমাজের প্রয়োজন মেটাতেই যেন তার জন্ম। কিন্তু বিনিময়ে ন্যূনতম সম্মান পাওয়া তো দূরের কথা, মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করাও যেন দুরাশা। এর মধ্যেই তার জীবনে আসে ভানিয়া, রাশিয়ার এক অভিজাত ব্যক্তির বখাটে ছেলে। খদ্দের হওয়ার সাথে সাথে ভানিয়া বিয়েও করতে চায় আনোরাকে। দিতে চায় স্ত্রীর স্বীকৃতি। আনোরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ভানিয়ার জোরাজুরিতে অল্প পরিচয়েই বিয়ে হয় তাদের। আনোরাকে অবশ্যই আকৃষ্ট করেছিল ভানিয়ার বিলাসব্যসনে পূর্ণ জীবন। সেই সঙ্গে ছিল একটা ফুটফুটে সুন্দর ঘর বাঁধার স্বপ্নও। কিন্তু বিয়ের বিষয়টি ভানিয়ার বাবা-মা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। বরং রাশিয়ায় এই খবর পৌঁছানোর পর পরই শুরু হয় তুমুল কাণ্ড। সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে ভানিয়ার ভিন্ন রূপ। বিয়ে বাতিলে উঠেপড়ে লাগে ভানিয়ার বাবা-মা। রূপকথার যে জীবনের হাতছানিতে রাজকন্যা হওয়া স্বপ্ন দেখছিল আনোরা, তা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে কাচের টুকরোর মতো ঝুরঝুর করে। কী করবে তাহলে আনোরা?
এই সিনেমাটি নিয়ে দ্য গার্ডিয়ান বলছে—‘রোমান্স, প্রত্যাখ্যান আর বিশ্বাসঘাতকতার এক আশ্চর্য শ্বাসরুদ্ধকর ট্র্যাজিক কমেডি।’ ওদিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ‘২০২৪ সালের তারকা সৃষ্টি করা সিনেমা আনোরা। অভিনয়শিল্পীদের পারফরম্যান্স ছিল দারুণ। গল্পের ছন্দময় গতি এবং আবেগের দুর্দান্ত ব্যবহারে অন্য সব সিনেমার চেয়ে এগিয়ে এটি।’
আনোরাতে দুরন্ত অভিনয় করেছেন নাম ভূমিকায় থাকা মাইকি ম্যাডিসন। তিনি কোনো নতুন মুখ নন। এর আগে কুয়েন্টিন টারান্টিনোর সিনেমাতেও অভিনয় করেছিলেন মাইকি। তবে আনোরা দিয়ে অভিনয়ের জগতে নিশ্চিতভাবেই শক্ত অবস্থান গড়ে ফেললেন তিনি। বাফটা’য় মাইকি ম্যাডিসন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও জিতেছেন সদ্যই। এর বাইরে পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে ইউরা বরিসভের উল্লেখ করতেই হবে। কম কথার, অভিব্যক্তিসর্বস্ব চরিত্রটিকে যেভাবে সুচারুরূপে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায়, তা সত্যিই অভাবনীয়।
এরই মধ্যে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব ও প্রতিযোগিতায় ২৭২টি মনোনয়ন পেয়ে ১৩১টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে শন বেকারের আনোরা। পরিচালক হিসেবে শন বেকারকেও দীর্ঘদিন জ্বালানি দেবে এ ছবি। এবার অস্কারে কী হয়, তাই দেখার পালা।
সিনেমা হলে মুক্তির পর এখন ইন্টারনেটের দুনিয়ায় প্রাইম ভিডিও ও অ্যাপল টিভি প্লাসেও দেখা যাচ্ছে আনোরা। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উপযোগী রেটিং পাওয়া প্রায় ২ ঘন্টা ২০ মিনিটের সিনেমাটি এমন বাস্তবতার মুখোমুখি দর্শকদের দাঁড় করায়, যেখানে থমকে যেতেই হয়। ভাবতে হয় জীবন নিয়ে, দুনিয়ার বানানো অনেক নিয়ম ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যেসব নিয়ম আমাদের শেখায় যে, কাকে অচ্ছুতের মতো করে বিচার করতে হবে! এই অচ্ছুতদের কাঁদতে মানা, কাঁদলেও সেই কান্নাকে অগ্রাহ্য করাই যেন দস্তুর। এসব মানুষের স্বপ্ন দেখাও নিষিদ্ধ। এভাবেই এই মানুষগুলোকে বানিয়ে দেওয়া হয় কথিত নিষিদ্ধপল্লীর স্থায়ী বাসিন্দা! সেখান থেকে বের হতে চাইলেও বের হতে দিতে চায় না কেউ!
আনোরা এই মানবদুনিয়ার একটা সহজ গল্পই দেখায় আমাদের। সেটাও প্রদর্শিত হয় একেবারে সোজাসাপ্টা ধরনে। সিনেমার একেবারে শেষ দৃশ্যে যখন আনোরা’র সব প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে, সব হারানোর দুঃখের বলক ওঠে, ঠিক তখন যেকোনো দর্শকেরই চোখের কোণা ভিজে যেতে বাধ্য। সিনেমার পর্দা নামতে নামতে মনের এক কোণায় একটি প্রশ্নও উঁকি দেয় প্রবল অস্বস্তিতে। আচ্ছা, এই ইট-কাঠের পৃথিবীতে, সব হারানোর দিনে আমাদের একটু জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার মানুষ আছে তো?