সুন্দরবনের ভেতর একটা দ্বীপ। সেখানে আশ্রয় নিয়েছে কিছু মানুষ। তাদের একটাই পরিচয়, উদ্বাস্তু। নতুন করে বাসা বেঁধে শুরু হয় তাদের জীবনের নতুন সংগ্রাম। কিন্তু এরই মধ্যে সেই ভিড়, ব্যস্ততায় ঢুকে পড়ে কিছু ফেউ। ঢুকে পড়ে রাজনীতির নোংরা খেলা।
বলা হচ্ছে নতুন ওয়েব সিরিজ ‘ফেউ’ নিয়ে। সম্প্রতি এই সিরিজটি মুক্তি দিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি। পরিচালনা করেছেন সুকর্ণ সাহেদ ধীমান। রোমেল রহমান ও সিদ্দিক আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে কাহিনী লেখায় ছিলেন পরিচালক নিজেও। ১ম সিজন বা চ্যাপ্টারে মোট ৭টি পর্বে সাজানো হয়েছে ‘ফেউ’। ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য এই সিরিজ উপযুক্ত বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে শুরুতেই।
ফেউ-এর গল্প নিয়ে চরকি লিখেছে, ‘১৯৭৯ সালে মোংলা চার্চের রেভেরেন্ড সুনীল সরকারের তোলা কিছু সংবেদনশীল ফটোগ্রাফের খোঁজে প্রায় দুই যুগ পরে রাস্তায় নামে তারই ছেলে ড্যানিয়েল। সেই রাস্তা তাকে নিয়ে যায় ডুমুরঝাঁপির মর্মান্তিক ইতিহাসের দিকে। যেখানে ফাঁদ পেতে আছে ভিনদেশি এজেন্ট, অর্থলোভী ব্যবসায়ী ও সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতারা।’ অর্থাৎ, ডুমুরঝাঁপি এখানে ইতিহাস তৈরির স্থান। সেটি মর্মান্তিক অবশ্যই।
গল্পের শুরুটা যেমন বলা হয়েছে, তেমনই। সুনীল সরকারের ডুমুরঝাঁপি যাওয়ার মধ্য দিয়েই সিরিজের যাত্রার শুরু। সেখানে ফেউ নিয়ে এক ধরনের সংজ্ঞায়নও পাওয়া যায়। দুই চরিত্রের আলাপ দিয়ে বলানো হয় যে, ফেউ মানে, ‘এজেন্ট। সরকারি গোয়েন্দা–গে এজেন্ট কয়।’
ফেউ মানে আসলে শেয়াল। ফেউ দিয়ে প্রচণ্ড ধূর্ত প্রকৃতিকেও চিত্রিত করা যায়। তবে যেহেতু সিরিজে ফেউ-এর একটি নির্দিষ্ট রূপকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তার খোঁজ করবে যেকোনো দর্শকই। তবে সেক্ষেত্রে দর্শকদের কিছুটা হতাশ হতেই হবে। কারণ গুটিকয়েক দৃশ্য ছাড়া সেই ধরনের ফেউয়ের দেখা খুব একটা প্রত্যক্ষ হয় না পুরো সিরিজে। ফলে একটা সময় এসে মনে হতেই পারে যে, সিরিজের নাম ‘ফেউ’ না হয়ে ‘ডুমুরঝাঁপি’ হলেও মন্দ হতো না। বরং তাতেই হয়তো উপযুক্ত হতো বেশি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা হয়ে গেছে যে, এই সিরিজের কাহিনীর সঙ্গে ইতিহাসের একটি শক্তিশালী যোগসূত্র আছে। পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট ওটিটি প্ল্যাটফর্মও জানিয়েছে যে, ১৯৭৯ সালের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘ফেউ’। পুরো সিরিজের গল্পই ‘সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত’। চরকি আনুষ্ঠানিকভাবেই বলেছে, সিরিজটি গড়ে উঠেছে মরিচঝাঁপি ম্যাসাকারের অনুপ্রেরণায়। ১৯৭৯ সালে সেখানে কী ঘটেছিল, তা জানানোর বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে। আবার নির্মাতা সুকর্ণ সাহেদ ধীমানের ভাষ্যে, ‘সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা একটি ফিকশনাল গল্প বলতে চেয়েছি। যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতিও উঠে আসবে।’
অর্থাৎ, মরিচঝাঁপিকেই প্রতীকীভাবে ডুমুরঝাঁপি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আছে সিরিজে। তবে সমস্যা হলো, মরিচঝাঁপি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ অধ্যায়। এ নিয়ে ঢের লেখালেখি হলেও, এ বিষয়ে সর্বসম্মত ইতিহাস পাওয়া কঠিন। রাজনীতির নানা প্যাঁচেই তা হয়েছে। ফলে এ নিয়ে যখন ‘ফিকশনাল’ গল্প বলা হয় এবং তাতে মরিচঝাঁপিতে কী ঘটেছিল, তা জানানোর ভাষ্য থাকে, তখন একটু তালগোল পাকে বৈকি। দর্শক কি এই ফিকশনাল গল্পকে ইতিহাসের দর্পণ হিসেবে ভাববে, নাকি ভাববে না? ভাবা কি উচিত, নাকি উচিত না? সুতরাং, এই গল্পে বলা কোন উপকরণকে সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া হবে বা যায়, তা নিয়ে এক নিদারুণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতেই পারে দর্শকমনে। এবং তাতে ইতিহাসের ভুল পাঠের আশঙ্কাও থাকে বটে।
এই ইতিহাস সংক্রান্ত ভ্রান্তির সুযোগকে একপাশে সরিয়ে এবার বরং শুধু ডুমুরঝাঁপির গল্প হিসেবে ‘ফেউ’ দেখা যাক। সেক্ষেত্রে বলতেই হবে যে, ‘ফেউ’ পর্দায় দেখতে বেশ লাগে। এর সিনেম্যাটোগ্রাফি চোখের জন্য প্রশান্তির। সুন্দরবনের এমন রূপ বাংলাদেশের তেমন কোনো সিরিজে এর আগে উঠে আসেনি। ফলে এ দেশের শহরকেন্দ্রিক গল্পের ভিড়ে ‘ফেউ’ উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। গল্পটি দর্শকদের ভিন্ন দুটি সময়ের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। গল্প এগোয় নন-লিনিয়ার ধারায়। দর্শকদের একবার ১৯৭৯ এবং পরক্ষণেই হয়তো ২০০২ সালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং এই দুই সময়ের মধ্যে পরিভ্রমণটা বেশ মসৃণ। ধাক্কা খুব বেশি লাগে না চোখে, মগজে। তবে হ্যাঁ, উদ্বাস্তু ও স্বাধীন দেশের নাগরিকদের পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে পার্থক্য আরও প্রকট হলে ভালো হতো। কারণ উদ্বাস্তু মানুষ দুর্দশায় কাতর থাকে এবং সেই দুর্দশা তাদের আচার-আচরণ ও পোশাকেও ফুটে বেরোয় বৈকি। তখন তা আরও বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে।
অভিনয়ের দিক থেকে ‘ফেউ’ পরিমিত। বিভিন্ন চরিত্রে ছিলেন চঞ্চল চৌধুরী, মোস্তাফিজুর নুর ইমরান, তানভীর অপূর্ব, হোসাইন জীবন, তারিক আনাম খান, তাহমিনা অথৈ, রিজভী রিজু, ফাদার জোয়া, বাবলু বোস, এ কে আজাদ সেতু প্রমুখ। এর মধ্যে সুনীল চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী, মার্শাল চরিত্রে মোস্তাফিজুর নুর ইমরান, কাজী চরিত্রে তারিক আনাম খান সাবলীল ছিলেন। চিত্রনাট্য অনুযায়ী নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় দক্ষতাই তাঁরা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। বাবা হিসেবে সুনীলকে খোঁজার যাত্রায় তানভীর অপূর্বকে চরিত্রের তুলনায় একটু কম বয়সীই মনে হয়েছে। তবে চরিত্র রূপায়ণে তাঁর অবিরত চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আর ফাদার জোয়া’কে তো ধন্যবাদ দিতেই হয়। তবে অভিনয়ের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে বলাই যায় যে, কোনো চরিত্রের পক্ষেই আলাদা করে দাগ কেটে যাওয়ার মতো সুযোগ হয়তো চিত্রনাট্যে খুব একটা ছিল না। ফলে একটি সাধারণ চরিত্রের অসাধারণ হয়ে ওঠার কোনো নিদর্শন বা লক্ষণ পাওয়া যায় না। হয়তো পরের সিজন বা চ্যাপ্টারে এমন উদাহরণ দেখা যেতে পারে। তাই, যদি চরিত্রের পরিচয় পর্ব হয়ে থাকে প্রথম সিজন, তাহলে আপত্তি তোলার সুযোগ কমই।
‘ফেউ’ সিরিজের ৭ম পর্ব যে জায়গায় শেষ হয়েছে, তাতে বোঝাই গেছে যে, অসমাপ্ত গল্পের শেষ দেখা যাবে পরের সিজন বা চ্যাপ্টারে। সুতরাং এমন আশা করাই যায় যে, আগামীতে হয়তো এই গল্পেই আরও নানামুখী মোড় আসবে। তখন নিশ্চয়ই গল্পের মিসিং লিংকগুলোও আর মনে খচখচানি উপহার দেবে না।
মোদ্দা কথা, ইতিহাসনির্ভর ওটিটি কনটেন্ট হিসেবে ‘ফেউ’ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে অন্তত। এখন সেই রাস্তায় আরও এগিয়ে গেলেই হয়তো আরও ভালো কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব। যেকোনো ম্যারাথনেই একটা স্টার্ট পয়েন্ট প্রয়োজন হয়। ‘ফেউ’ সেটি হওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন অন্যরা এগিয়ে এলেই ভালো।