এক হাতে ফোন, অন্য হাতে চাবি, লিপবাম, চার্জার আর তার সঙ্গী সেই আবশ্যক ‘ইমোশনাল সাপোর্ট’ পানির বোতল। এমন দৃশ্য অনেক নারীর দৈনন্দিন বাস্তবতা। এই ব্যস্ত হাতে জিনিসপত্র সামলানোর কৌশল যেন আজকাল এক অদৃশ্য সুপারপাওয়ারে রূপ নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মেয়েরা কি স্বেচ্ছায় এসব বহন করছে? না, বরং বাধ্য হচ্ছে। কারণ তাদের পোশাকে নেই পকেট।
সত্যি বলতে, নারীদের পোশাকে কার্যকর পকেট পাওয়া এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায় ব্যাপার। থাকলেও তা হয় সেলাই করে রাখা, নয়তো এত ছোট যে এক টুকরো চুইংগাম রাখাও মুশকিল। বিপরীতে, পুরুষদের পোশাকের পকেট এমন বড় যে যেন ছোটখাটো জিনিসপত্র তো নয়, পুরো গল্পই বহন করা যায়।
পেছনে ফিরে তাকালেই স্পষ্ট হয় আসল চিত্র
পকেটের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীনকালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোমরে ঝোলানো থলে ব্যবহার করতেন। মধ্যযুগে চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সেই থলি পোশাকের নিচে লুকিয়ে রাখা শুরু হয়।
১৭শ শতকে পুরুষদের পোশাকে স্থায়ী পকেটের প্রচলন শুরু হয়। অথচ তখনও নারীরা লম্বা স্কার্টের নিচে লুকানো থলির ওপর নির্ভরশীল। ধারণা করা হয়, ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক প্রচারপত্র বা নিষিদ্ধ বস্তু লুকাতে না পারার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে নারীদের জামা থেকে পকেট বাদ দেওয়া হয়েছিল।
পকেট মানেই একধরনের ক্ষমতা
১৮০০ সালের দিকে ছোট, অলঙ্কৃত ব্যাগ নারীদের ফ্যাশনের অংশ হয়ে ওঠে। তবে সে ব্যাগে কাজের চেয়ে সৌন্দর্যের প্রাধান্য বেশি ছিল। ২০শ শতকের শুরুতে নারীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করলে বদলাতে শুরু করে ছবিটা। সাফ্রাজেট আন্দোলনের নারীরা প্রতিবাদের অংশ হিসেবে জামায় পকেট যোগ করেন।
১৯২০-এর দশকে ফ্যাশন জগতে বিপ্লব ঘটান কোকো শ্যানেল। তার নকশায় জায়গা পায় পকেট। নারীদের পোশাকে এক নতুন বার্তা। যেখানে রূপের সঙ্গে আসে বাস্তব প্রয়োজনের সম্মান।
এ ভালোবাসা স্থায়ী হয়নি
যখন স্লিম সিলুয়েট আর নারীত্বের আদর্শে ফ্যাশনের সংজ্ঞা বদলাতে শুরু করল, তখন পকেটকে বলি হতে হলো স্টাইলের অল্টারে। নারীদের পোশাকে পকেট না থাকার ইতিহাস, এক কথায়, পুরুষতান্ত্রিক এক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
দীর্ঘদিন ধরেই নারীরা পকেটের বিকল্প হিসেবে ব্যাগের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছেন। হ্যান্ডব্যাগের প্রতি অনেকে টান অনুভব করলেও, বাস্তবে তা ছিল প্রয়োজনের চেয়ে বাধ্যবাধকতার ফল। ১৯৫৫ সালে শ্যানেল যখন কাঁধে ঝোলানো আইকনিক ২.৫৫ ব্যাগ বাজারে আনে। তখনই প্রথম নারীদের দুই হাত কিছুটা মুক্ত হয়।
কেবল আরাম নয়, পকেট মানে স্বাধীনতাও
নারীদের জামায় পকেটের অনুপস্থিতি নিছক ডিজাইনের সীমাবদ্ধতা নয়। বরং এটি এক গভীর সামাজিক বৈষম্যের চিহ্ন। যে সমাজে নারীদের পোশাককে দেখতে সুন্দর হতে হয়, কিন্তু ব্যবহারিক হওয়া জরুরি নয়।
এখানে আরেকটি প্রশ্নও থেকে যায়। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো শুধুমাত্র হ্যান্ডব্যাগ বিক্রি করে আয় করছে বিপুল অর্থ। তাতে মনে হতেই পারে ইচ্ছাকৃতভাবেই নারীদের পোশাক থেকে পকেট বাদ দেওয়া হচ্ছে? হয়তো সরাসরি বলা কঠিন, কিন্তু ইতিহাস আর বর্তমান ট্রেন্ড মিলিয়ে দেখলে, সংযোগের রেখাগুলো স্পষ্টই চোখে পড়ে।
পকেটের অভাব নিছক একটি ফ্যাশন সমস্যা নয়। এটি এক দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর অংশ। যেখানে নারীদের প্রয়োজন নয়, চাহিদা তৈরি করাই ছিল মূল লক্ষ্য। আর সেই ফাঁকেই হেঁটে এসেছে হ্যান্ডব্যাগের বাজার। আর হারিয়ে গেছে নারীদের পোশাকের বহুপ্রত্যাশিত পকেট।
তথ্যসূত্র: টাইমস নাউ