শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশ অত্যন্ত স্বতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া। প্রতিটি শিশুর গতি এবং প্রক্রিয়া আলাদা। তাই অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের স্বতন্ত্র বিকাশের প্রতি সম্মান দেখানো। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ সময়ই জানি না, নিজের সন্তানকে অন্য শিশুদের সঙ্গে তুলনা করার সময় যে ছোট ছোট মন্তব্য করি, তা শিশুর মনে কতটা গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে পারে।
এখানে কিছু বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে কেন সন্তানের সঙ্গে অন্যদের তুলনা বন্ধ করা প্রয়োজন।
১. আত্মবিশ্বাসে প্রভাব
তন্বী, ৭ বছর বয়সী এক মেয়ে, তার মা-বাবার কাছে সবসময় শুনত, ‘তুমি কি জানো, মুসাবি তোমার ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্র?’ মুসাবি তার ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল এবং তন্বী তার তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে ছিল। একদিন তন্বী তার মা-বাবাকে বলে, ‘আমি আর কিছুই ভালো পারি না, কারণ মুসাবি সবসময় সেরা।’ এর ফলে তন্বীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে বাবা-মা বুঝতে পারলেন, তুলনা করাটা তাকে আরও হতাশ করেছে এবং তার আত্মবিশ্বাস কমিয়েছে। পরবর্তীতে তারা তার বিশেষ গুণাবলীর প্রশংসা করতে শুরু করলেন এবং একপর্যায়ে তন্বী নিজের গতিতে উন্নতি করতে সক্ষম হয়।
২. প্রতিযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি
রিয়ান এবং আলিয়া, দুই ভাইবোন, তাদেরকে বাবা-মা সবসময় তুলনা করে বলতেন, ‘রিয়ান! তোমার থেকে আলিয়া বেশি ভালো পড়াশোনা করে, তুমি কেন তা পারো না?’ এই তুলনা তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি করে। তারা একে অপরকে পরাজিত করতেও চায়। কিন্তু তারা কখনো একে অপরকে সহযোগিতা করে না। এর ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে। একপর্যায়ে তাদের বাবা-মা যখন বুঝতে পারলেন যে, তুলনা করাটা তাদের সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরাচ্ছে, তখন তারা সন্তানের নিজস্ব অর্জন এবং গুণাবলি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, যা পরবর্তীতে তাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে।
৩. সন্তানের বিকাশে বাধা
নিলয় এবং সুমি দুইজনই এক স্কুলে পড়াশোনা করে। নিলয় খুব ভালো অ্যাথলেট ছিল। কিন্তু সুমি সবার মতো খেলাধুলায় আগ্রহী ছিল না। তাকে তার মা-বাবা বলতেন, ‘নিলয় তো ভালো খেলছে, তুমি কেন খেলতে চাও না?’ সুমি কখনোই খেলাধুলায় আগ্রহী ছিল না, কিন্তু তার মা-বাবার এই তুলনা তাকে চাপে ফেলেছিল। সুমি মনে করে, তাকে দিয়ে কোনো ভালো কাজই হবে না। কারণ সে নিলয়ের মতো খেলাধুলায় ভালো করতে পারে না। তাই সে সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে সুমি যখন নিজের পছন্দের বিষয়ে মনোযোগ দেয় এবং আর্টের প্রতি আগ্রহ দেখায়, তখন সুমি নিজের পরিচয় খুঁজে পায় এবং সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
৪. মানসিক চাপ
মায়া, ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে, সে স্কুলে অনেক ভালো কাজ করত, তবে সে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়মিত শুনত, ‘তোমার বন্ধু আরিফ তো তোমার থেকে অনেক ভালো পড়াশোনা করে!’ মায়া এ ধরনের কথা শুনতে শুনতে মানসিকভাবে চাপ অনুভব করে। এতে তার সেরা কাজগুলোও অবমূল্যায়িত হতে থাকে। সে মনে করে, কখনো আরিফের মতো হতে পারবে না। একদিন মায়ার শিক্ষক তার মাকে জানালেন মায়ার আত্মবিশ্বাস কমে গেছে এবং তার মধ্যকার মানসিক চাপ তাকে সঠিকভাবে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতেও বাধা দিচ্ছে। এরপর মায়ার মা তার বিশেষ গুণাবলীর প্রশংসা করে বলেন, ‘তুমি অনেক বেশি সৃজনশীল এবং বিভিন্ন বিষয়ে তোমার দক্ষতা খুবই স্পষ্ট’। এতে মায়া নিজের সৃজনশীলতা খুঁজে পায়।
৫. সম্পর্কের ক্ষতি
হাসান ও শারমিন, দুই ভাইবোন, তারা বাবা-মায়ের কাছে প্রায়ই শুনত, ‘শারমিন এত ভালো আঁকে, তুমি কেন আঁকতে পারো না, হাসান?’ হাসান ভাবতে লাগে, সে কখনো ভালো কিছু তৈরি করতে পারবে না, কারণ তার তুলনা সবসময় শারমিনের সঙ্গে করা হয়। এতে তাদের মধ্যে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়। হাসান বুঝতে পারে যে, তার বাবা-মা তাকে ভালোবাসবে না, যদি না সে শারমিনের মতো কিছু করতে পারে। একদিন বাবা-মা যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন, তখন তারা হাসানের নিজস্ব পছন্দ এবং দক্ষতার প্রতি আরও মনোযোগ দিতে শুরু করলেন এবং শারমিনের দক্ষতার সঙ্গে তুলনা করা বন্ধ করে দিলেন। এতে হাসান নিজের সৃজনশীলতা খুঁজে পেয়ে অনেক ভালো কাজ করতে শুরু করলেন।
এসব বাস্তব জীবনের উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, কোনো শিশুকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা হলে তাদের আত্মবিশ্বাস, ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি শিশু যখন নিজের গতিতে ও তার পছন্দের পথে এগোতে পারে, তখন তারা সত্যিকার অর্থে নিজের সর্বোচ্চ সক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। আমাদের উচিত আমাদের সন্তানের গুণাবলির প্রশংসা করা এবং তাদের মনোযোগ ও সমর্থন দিয়ে তাদের উন্নতির পথে সহায়তা করা। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি শিশু একটি আলাদা রত্ন, যা তার নিজস্ব শর্তে এবং গতিতে উজ্জ্বল হবে।
লেখক: শিশু বিকাশ বিষয়ক গবেষক, শিশুবিকাশ ডট কম