আমাদের প্রত্যেকেরই সম্পর্ক নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ‘চাহিদা’ থাকে। এই চাহিদা মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক। আবার মোটা দাগে নিয়ে আসলে বস্তুগত চাহিদা, যেমন: অর্থ-সম্পদ, কোথাও একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদিও থাকে। যখন সম্পর্কে থাকা কোনো একজন মনে করেন, অপরজন সেই চাহিদাগুলো ঠিকমতো পূরণ করতে পারছেন না, তখন প্রথমেই প্রয়োজন ঝগড়া না করে খোলামেলাভাবে নিজের চাহিদাগুলো সম্পর্কে বলা।
নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনায় দুটো লাভ হয়। প্রথমটি হচ্ছে, অপরজন যেহেতু অন্তর্যামী নন, তাই খোলামেলা আলোচনায় তিনি বুঝতে পারবেন তার কী করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়টি হলো, প্রথমজন তার চাওয়াগুলো নির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ পান। এখানে খেয়াল রাখা দরকার চাওয়া–পাওয়া যেন বাস্তবসম্মত যৌক্তিক মাপকাঠিতে হয়।
এবার, যদি দেখা যায় একজন খোলামেলা আলোচনায় তার চাহিদাগুলো বলছেন, কিন্তু অপরজন আন্তরিকভাবে সেই যৌক্তিক চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসছেন না সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও, তখন জন্ম হয় তিক্ততার। এবার আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসবেন কিনা?
একবার ভাবুন তো হঠাৎ করে খুব বিপদে পড়েছেন। সব থেকে আগে কাকে বলবেন? যাকে বলবেন, তিনি আপনার জীবনসঙ্গী। তবে, কর্মক্ষেত্রে বিশ্বস্ত বা কর্মক্ষেত্রের বাইরে বন্ধু থাকা দোষের নয়। কিন্তু যদি সেই মানুষটি আপনার প্রথম প্রায়োরিটি হতে থাকে, তবে বিষয়টি ভাবনার। আপনি কি জীবনসঙ্গীকে বাদ দিয়ে, সেই সহকর্মী অথবা বন্ধুটির কাছ থেকে মানসিক সাহস নিচ্ছেন?
জীবনসঙ্গীর পরিবর্তে যদি বাইরের মানুষের কাছ থেকে মানসিক সাহস নিতে থাকেন, তবে অবশ্যই আপনার সম্পর্কের ব্যাকরণে ভুল আছে। যদি আপনি নিজের সঙ্গী বাদে অন্যের কাছ থেকে ক্রমাগত মানসিক, ক্ষেত্রবিশেষে শারীরিক সাহায্য নিয়ে চলছেন তাহলে এটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে সম্পর্কটি থামিয়ে দেওয়ার।
সঙ্গীর সাথে যখন আপনার খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ থাকে না, তখন আপনার চাহিদা তুলে ধরতে অস্বস্তি হতেই পারে। নিঃসংকোচে সঙ্গীর কাছ থেকে কিছু চাইতে ভয় পেলে ইঙ্গিত করে যে, সেই সম্পর্কের গাঁথুনি দুর্বল। ফলে নিজের চাহিদাগুলোকে অবদমিত রাখতে রাখতে একটা সময় আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি। আর এই অধৈর্য অবস্থা প্রকাশিত হয় তিক্ততা, অসন্তোষ, বিদ্বেষ, ক্ষোভ ও ঝগড়ায়। কাজেই আমরা যতই রেখে ঢেকে কথা বলব, ততই সম্পর্কে বিষবাষ্প জমবে। যে সঙ্গীর সাথে মন খুলে কথা বলতে ভয় পান, সেই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাই সম্ভবত মঙ্গলজনক।
আপনার পরিবারের সেই মানুষগুলো যারা আপনার মঙ্গল চান অথবা আপনার বিশ্বস্ত পরীক্ষিত বন্ধুবান্ধব, তারা এই সম্পর্কটিকে যদি স্বাস্থ্যকর মনে না করেন, তবে সেটা কিন্তু বিপদসংকেত। যদি এই সম্পর্কটি রাখার জন্য আপনাকে আপনার বন্ধুদের কাছে অথবা পরিবার বা আত্মীয়-স্বজনের কাছে মিথ্যে বলতে হয়, তবে এই সম্পর্কটি কিন্তু আপনার জন্য সঠিক নয়।
২০১৬ সালে কারেন্ট সাইকোলজির এক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যক্তি যে সম্পর্কে যত বেশি সময় এবং শ্রম দান করেন, সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তিনি তত বেশি সচেষ্ট থাকেন। এটা অনেকটা অর্থ বিনিয়োগের মতন। যেটাকে বলা হয় সাঙ্ক কস্ট ইফেক্ট। মানসিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে সাফল্যের কিন্তু খুব বড় যোগসূত্র নেই। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে আপনি একটি সম্পর্কে আছেন বলে যে কোন মূল্যে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হবে, এমন কথা নেই। অনেকদিন থাকলেই একটা সম্পর্ক যে সুখের হবে, একথা প্রযোজ্য নয়। অনেক সময় বলা হয় যে, ধীরে ধীরে মন বসবে! এটা আসলে একটি মিথ।
মনস্তত্ত্বে দেখা যায়, ঝগড়া–বিবাদ বা মনোমালিন্যের মধ্যেও একটি সম্পর্ক টিকে যায়, যখন সেখানে পারস্পরিক পছন্দ থাকে। কিন্তু দুজন মানুষ যদি কেউ কাউকে পছন্দই না করেন, তাদের সারাটা জীবন একসাঙ্গে থাকাটা দুরূহ বিষয়। ভালোবাসার মানুষকে চট করে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু মনস্তত্ত্ব বলে, এক্ষেত্রে হৃদয়ের নয়, মস্তিষ্কের উপদেশ শোনা প্রয়োজন। কারণ মস্তিষ্ক যুক্তিনির্ভর।
সঙ্গীর শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন সহ্য করাকে না বলুন। একজন মানুষ কখনোই নীতিগতভাবে আরেকজনের উপর নির্যাতন করতে পারে না। আমাকে ভালোবাসে বেশি বলে দুটো থাপ্পড় মারল—এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন এক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রতি ৪ জন নারী এবং ১০ জন পুরুষ তার সঙ্গী দ্বারা নির্যাতিত হন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মতো দেশে এর হার আরও বেশি।
এখন প্রশ্ন হল, কেন নির্যাতকের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা হয়? বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে অনেক নারী নির্যাতন করা পুরুষ সঙ্গীকে অতিমাত্রায় নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এ ধরনের নির্যাতনকারী সঙ্গীর মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার ইতিবাচক দিক থাকে যে, তারা অসম্ভব যত্নশীল। ফলে যত্ন দেখতে গিয়ে নির্যাতনকে অস্বীকার করা হয়। এটি সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর। যেকোনো নির্যাতকের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ সম্পর্ক ছেদ করা প্রয়োজন। কারণ, আপনার সর্বপ্রথম দায়িত্ব নিজেকে যে কোনো নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে ট্রমা বন্ডিং যেন না হয়, সেক্ষেত্রে সচেতন থাকা প্রয়োজন। তাই এমনটা হলে কাউন্সেলিংয়ের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি।
লেখক: কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার