হায়দার আকবর খান রনো, বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ। গত শুক্রবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর শুনে রাতেই হাসপাতালে দেখতে যাই। হাসপাতালে ঢুকতেই দেখা হয়, তাঁর চিকিৎসক চন্দ্র শেখর বালার সঙ্গে। তিনি জানান, অবস্থা খুব একটা ভালো না। তবুও তিনি হাল ছেড়ে না দিয়ে মনে সাহস রাখতে বলেন। মনের সেই সাহস নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে পাঁচ তলায় পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সতীর্থ ও গুণগ্রাহীরা শেষবারের মতো রনোকে দেখার জন্য হাসপাতালে এসেছেন।
রাত যত এগোয়, ততই হায়দার আকবর খানের শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে গভীর রাতে পৃথিবীর সকল মায়া ছেড়ে তিনি চলে যান অনেক দূরে।
গভীর রাতে দায়িত্বরত চিকিৎসক যখন তাঁর মৃত্যুর কথা জানান, তখন দৌড়ে ছুটে যাই হাসপাতালের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ)। রুমে গিয়ে দেখলাম, রনো ভাইয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। যেন চুপচাপ ঘুমিয়ে আছেন। যে রনো ভাইয়ের সঙ্গে সময়ে অসময়ে এতো কথা বলেছি, আজ তাঁকে নিঃশব্দে ঘুমাতে দেখলাম। যে ঘুম থেকে তিনি আর জেগে উঠবেন না। দেখলাম দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা তাঁর শরীর থেকে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি খুলে নিচ্ছেন। এই দৃশ্য বড়ই বেদনাদায়ক।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম মানুষ অক্সিজেন ছাড়া বাচঁতে পারে না। এই কথা অনেক করুণভাবে রনো ভাইয়ের মৃত্যুতে মনে আঘাত হানে। যদিও শুনেছি সন্ধ্যা থেকে তাঁর অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। তারপরে ভেবেছিলাম অপার্থিব যদি কিছু হয়, তাহলে হয়তো আরও কিছুদিন তিনি বেঁচে থাকবেন। কিন্তু বিজ্ঞান তো বিজ্ঞানই। অক্সিজেনের অভাবে মানুষকে মারা যেতেই হবে। শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ৫ মিনিটে মারা যান তিনি।
হায়দার আকবর খান তীব্র শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ (টাইপ-২ রেসপিরেটরি ফেলিউর) নিয়ে গত ৬ মে সন্ধ্যায় পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রেখে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গত শুক্রবার বিকেল থেকেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অবশেষে জগৎ সংসারের সকল মায়ার বন্ধন পেছনে ফেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন প্রবীণ এই বামপন্থী নেতা।
মৃত্যুতেই রনোর চোখের আলো নিভে যায়নি। কারণ মৃত্যুর আগে তিনি চোখ দান করে গেছেন। তাঁর চোখ দুটি গ্রহণ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানী। তাঁর চোখ দিয়ে এই পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন দুজন অন্ধ মানুষ।
এই ভূখণ্ডে খুব কম মানুষ আছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। রনো ভাই ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালে কলকাতায়। আর মৃত্যু ২০২৪ সালের ১১ মে। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি দেখেছেন ব্রিটিশ ভারত, দেশভাগ, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৮২ সালের সামরিক শাসন, ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান ও তারপরের বাংলাদেশকে।
বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ ছিল। এক চোখ দিয়ে বলতে গেলে কিছুই দেখতেন না। অন্য চোখে যা দেখতেন, তাও ছিল নামমাত্র। মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে তিনি নাম বলে দিতে পারতেন। জীবনের শেষের দিনগুলোতে চোখে দেখতে না পাওয়া ছিল, তাঁর অনেক বড় আফসোসের জায়গা। কারণ এই মানুষটি পড়ালেখা করতে খুব ভালোবাসতেন।
হায়দার আকবর খান গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। টানা ১৩ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। বলা যায়, তাঁর সাহসী জীবনীশক্তির কাছে করোনা হার মেনেছিল। তবে করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেলেও অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল রনো ভাইয়ের নিত্যসঙ্গী।
হায়দার আকবর খান রনোকে বহু আগে থেকে চিনতাম তাঁর লেখনী দিয়ে। খুব সহজ করে সারাটা জীবন লিখে গেছেন তিনি। আর সেই লেখনী দিয়ে মানুষের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলেন। হায়দার আকবর খান রনোর মোট বইয়ের সংখ্যা ২৫টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসীয় অর্থনীতি, গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাঁধো, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন, রবীন্দ্রনাথ শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে, মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ, বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা, পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট (পুস্তিকা), মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিরা।
রনো ভাইয়ের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও তাঁর কাজ থেমে ছিল না। তিনি গত কয়েক বছরে শ্রুতিলেখকের মাধ্যমে তিনটি বইয়ের সম্পাদন করেন। বইগুলো হলো সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লেনিন, স্তালিন এবং নারী ও নারীমুক্তি।
গত দুই থেকে তিন বছর পেশাগত কারণে অথবা আড্ডার দেওয়ার জন্য হায়দার আকবর খান রনোর বাসায় যাওয়া হয়েছে বহুবার। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বলতেন তিনি। মনে হতো আমিই সেই সময়ে অবস্থান করছি। কথা বলতে বলতে জেনেছি অনেক ইতিহাসের কথা। যে ইতিহাসের কথা বইয়ের পাতায় লেখা ছিল না।
হায়দার আকবর খান রনো তাঁর জীবনে তিনটি রাজত্বের পতাকা দেখেছেন। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, আর বাংলাদেশের পতাকা। ১৯৪২ সালে জন্মে তিনি দেখেন ব্রিটিশ ভারতকে, এরপর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের হলো দেশভাগ। তিনি প্রায় দীর্ঘ ২৪ বছর কাটিয়েছেন পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। সেই স্বাধীন দেশে তিনি কাটিয়েছেন আমৃত্যু।
রনো দীর্ঘদিন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্রজীবনেই শুরু হয় তাঁর প্রথম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৬৩ সালে শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, ১৯৬১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ ছিল রনোর জীবনের প্রথম রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। আর ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্রসভা হয়েছিল, সেখানে বক্তা ছিলেন তিনি। ছাত্রজীবন শেষে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। টঙ্গি অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে থেকে গড়ে তোলেন শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৭০ সালে রনো ভাই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
হায়দার আকবর খান রনো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দৃঢ়ভাবে মনে করতেন, ১৯৭১ সাল ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ গৌরবের ভাবতেন। আর নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করতেন। রনো মনে করতেন, ‘যে উদ্দেশ্য আর লক্ষ্য নিয়ে আমরা পাকিস্তানকে পরাজিত করেছিলাম। সে লক্ষ্য কিন্তু এখন বহুলাংশে ব্যর্থ।' তিনি যে কথা সব সময় বলতেন তা হলো, বাংলাদেশের মাটিতে মৌলবাদ কোনো দিনও বিজয়ী হতে পারবে না।’
১৯৬১ সালে হায়দার আকবর খান রনো তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালেই তিনি এই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে পরিগণিত হন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০১০ সালে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে তিনি ওয়ার্কার্স পার্টি ত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তখন থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। এ ছাড়া হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার। তিনি চারবার কারাবরণ করেছেন, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। আয়ুব ও এরশাদ আমল মিলিয়ে তাঁর বাসায় রেড হয়েছে অর্ধশতাধিকবার।
হায়দার আকবর খান এ দেশের রাজনীতির বহু উত্থান-পতন দেখেছেন। যেমন দেখেছেন মানুষের জাগরণ, তেমন দেখেছি মানুষের অধঃপতন। একবার রনোর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, জীবন সায়াহ্নে এসে কী চান? তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথের কথা বিশ্বাস করি। রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে লিখেছেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই কথা আমি বিশ্বাস করি। এ দেশের মানুষ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এ দেশের জনগণ ভবিষ্যতেও লড়াই করে অধিকার অর্জন করবে। আমার চাওয়া-যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হোক।’হায়দার আকবর খান একজন কিংবদন্তী ছিলেন। তিনি আরও কিছুকাল বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এই পৃথিবীর আলো আর দেখতে পাবেন না। তবে মৃত্যুতে নিঃশেষ হবেন না রনো ভাই। তিনি তাঁর আদর্শ, লেখনী আর মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন। তাঁর সঙ্গে আর কথা বলা হবে না। তবে, তাঁর সঙ্গে কাটানো সময় ভুলে থাকা অসম্ভব।
কমরেড রনো, বিদায়…
লেখক: সহ সম্পাদক, ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটাল