সেকশন

রোববার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
Independent Television
 

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

হ‌ুমায়ূন আহমেদের মতো আর কেউ জনপ্রিয় হতে পারছেন না কেন

আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ পিএম

জনপ্রিয়তা কে না চায়? লেখকদের মধ্যে এই জনপ্রিয়তার আদিম বাসনা চাগিয়ে দিয়েছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। বিপুল পাঠক বইমেলায় লেখককে ঘিরে আছেন, একটুখানি অটোগ্রাফের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, প্রিয় লেখককে একনজর দেখার পর পাঠকের চেহারায় ফুটে উঠছে স্বর্গের ফুল–এসব দৃশ্য নিজের চারপাশে দেখার স্বপ্ন দেখিয়েছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। কিংবা শুধু লেখালেখি করেই বিপুল বিত্ত‑বৈভবের মালিক হওয়া, একটি স্বপ্নের মতো রাজকীয় জীবন যাপন করা–এসব লজ্জাহীন স্বপ্নেরও বীজ বপন করে দিয়ে গেছেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ।

কিন্তু পরিহাসময় শোনালেও সত্য, হ‌ুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর এত বছর পরও কেউ হ‌ুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ছুঁতে পারেননি। যাঁরা বাংলা আহিত্যের একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, যাঁরা নিবিড়ভাবে বাংলা সাহিত্যের অন্ধি‑সন্ধি ও গলি‑গুপচি ঘুরেছেন, অন্তর্লীন চোখ মেলে খুনের তদন্তের মতো সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন বাংলা সাহিত্যে, তাঁরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, হ‌ুমায়ূন‑পরবর্তী অধিকাংশ লেখকই চেতনে‑অবচেতনে হ‌ুমায়ূনের মতো জনপ্রিয় হতে চেয়েছেন। কিন্তু সফল হননি। আশির দশক থেকে ২০২৪‑এর এই অন্তর্বর্তী সময়ে গন্ডায় গন্ডায় লেখক বইমেলায় ধুলো উড়িয়েছেন এবং অন্ধের মতো হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখা অনুকরণ করেছেন। তবু হ‌ুমায়ূনের মতো জনপ্রিয় হতে পারেননি।

কেন?

মোটা দাগে কয়েকটি কারণ এর পেছনে দায়ী হতে পারে।

প্রথমত: হ‌ুমায়ূন আহমেদের গল্প বলার ধরন। এটি এতই বিরল ও ব্যতিক্রম যে, শত চেষ্টাতেও ধরনটি অনুকরণ করা যায় না। হ‌ুমায়ূন আহমেদের গল্প উপস্থাপনের কৌশল এতটাই স্বতন্ত্র যে, পৃথিবীর আর কোনো লেখকের সঙ্গে কৌশলটি মেলে না। সবাই বলার চেষ্টা করেন, হ‌ুমায়ূন আহমেদ ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেন এবং সহজ‑সরল শব্দ ব্যবহার করেন, এ জন্য হ‌ুমায়ূন পড়তে এত ভালো লাগে। এটি একটি কৌশল বটে, তবে একমাত্র কৌশল নয়। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, শুধু এই এক কারণে হ‌ুমায়ূন আহমেদ ‘হ‌ুমায়ূন আহমেদ’ হয়ে ওঠেননি। সহজ‑সরল শব্দে এবং ছোট ছোট বাক্যে আরও অনেকেই লিখেছেন (জহির রায়হানের কথা বলা যেতে পারে), কিন্তু হ‌ুমায়ূন আহমেদের অনন্যতা অন্যখানে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ প্রতি প্যারায় প্যারায় পাঠককে চমকে দেন। চমকে দেওয়া লেখকদের অন্যতম গুণ। অনেক লেখক দেখা যায় দু‑চার পাতার পর একটা চমক দেন। অনেক লেখক একটা অধ্যায়ের শেষে চমক রাখেন, যাতে পাঠক পরের অধ্যায় পড়তে আগ্রহ বোধ করেন। আর হ‌ুমায়ূন আহমেদ পাঠককে চমকে দেন ক্ষণে ক্ষণে। দু‑চার-দশ লাইন পরপরই চমক থাকে। পাঠক চমকাতে চমকাতে একটা বিস্ময়কর ঘোরের মধ্যে চলে যায়। হ‌ুমায়ূন আহমেদের এই অনন্য কৌশলটি আয়ত্তে আনতে তরুণ লেখকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু কোথাও যেন খামতি রয়ে যাচ্ছে। ঠিক সুরে বীণাটি বাজছে না।

গল্পের প্রয়োজনেই চরিত্রগুলো আসে ও যায়। কিন্তু সব চরিত্র পাঠককে নাড়া দেয় না। এ ক্ষেত্রে হ‌ুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রম। ফাইল ছবি

হ‌ুমায়ূনের দ্বিতীয় গুণ–সংলাপ। এত সাবলীল ও স্বতন্ত্র সংলাপ বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখক লিখেছেন। তৃতীয় গুণ–উইট। তাঁর সংলাপগুলো হিউমারে ভরপুর। পাঠক পড়তে পড়তে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েন।

চতুর্থ গুণ–চরিত্র সৃষ্টি। যেকোনো উপন্যাসে অনেকগুলো চরিত্র থাকে। গল্পের প্রয়োজনেই চরিত্রগুলো আসে ও যায়। কিন্তু সব চরিত্র পাঠককে নাড়া দেয় না। এ ক্ষেত্রে হ‌ুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রম। তিনি অল্প কথায় সংলাপের মাধ্যমে, ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে চরিত্র সৃষ্টি করেন এবং চরিত্রগুলো একটা সময় জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠক তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। তাদের দুঃখে অশ্রুপাত করেন, হিউমারে হেসে কুটি কুটি হন। শুধু সংলাপ ও ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি করার এমন ক্ষমতা আর কোনো লেখকের আছে কি? আমাদের অন্তত জানা নেই।

সব লেখকই কোনো না কোনো চরিত্রের মধ্য দিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু চরিত্রগুলোতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। যেসব লেখক চরিত্রের মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, সেসব চরিত্রই কালজয়ী হয়ে দশকের পর দশক টিকে আছে। উদাহরণ হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মহেশ’ গল্পের কথা বলা যেতে পারে। শরৎচন্দ্র মহেশের মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলে সামান্য এক গরুর জন্য পাঠকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। মহেশ তাই এত বছর পরও পাঠকের মনে বেঁচে আছে।

হ‌ুমায়ূনের পঞ্চম গুণ–গল্পের প্লট। আহামরি কিছু নয়। খুবই সাধারণ। মধ্যবিত্ত, আটপৌরে জীবন। দেখবেন, তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বর খুব অনুচ্চ। তারা খুব প্রতিবাদী নয়, বিপ্লবী নয়। না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, না সমাজের বিরুদ্ধে, না নিজের বিরুদ্ধে–কোথাও কেউ বিপ্লব করে না। সবাই আপস করে চলে। যে দু‑একটি চরিত্র সামাজিক বিপ্লবের চেষ্টা করেছে, তারাও আপসের মধ্য দিয়ে বিপ্লব করেছে। এই মানুষেরা আমাদের চারপাশেই ঘোরাফেরা করছে। আমাদের চোখে দেখা বাবা, চাচা, মামা, বড় ভাই, মা, বোন, খালা, ফুপু, খালু সাহেব–সবাই তো এ রকমই। মৃদু মানুষ। প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে আপস করে বেঁচে থাকছেন তাঁরা। এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন বেঁচে থাকাই হ‌ুমায়ূন আহমেদের গল্পের প্লট। এমন প্লট মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

হ‌ুমায়ূন সাহিত্যের ষষ্ঠ গুণের নাম ‘আবেগ’। নজরুলের যেমন ছিল এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য, তেমনি হ‌ুমায়ূনের এক হাতে ছিল উইট আরেক হাতে ইমোশন। দুটো যন্ত্রই তিনি সমানতালে বাজাতে পারতেন। এই এখনই পাঠককে হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে ফেলছেন তো পরক্ষণেই চোখে অশ্রু এনে দিচ্ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হ‌ুমায়ূন যে আবেগ সৃষ্টি করেন, সেই আবেগের কারণে হাউমাউ করে কান্না আসে না, একটা চাপা কান্না তৈরি হয়। গলার মধ্যে কিছু একটা আটকে থাকে। বুকের মধ্যে অসীম শূন্যতা তৈরি হয়।

এখানেই সম্ভবত হ‌ুমায়ূনের সবচেয়ে বড় অনন্যতা যে, তিনি একঝাঁক মৃদু মানুষের হাহাকার পাঠককূলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। বাকের ভাই যতই মাস্তান হোক, তার জন্যও আমরা হাহাকার অনুভব করি, মুনার জন্য হাহাকার অনুভব করি, মুনার মামার জন্য কষ্ট পাই, বকুলের জন্য কষ্ট পাই, এমনকি রুক্ষ উকিলটার জন্যও মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। আমাদের বদিউল আলমের জন্য হাহাকার লাগে, রাবুর জন্য হাহাকার লাগে, খোকার জন্য কষ্ট লাগে, আনিসের জন্য মন কেমন কেমন করে।

হ‌ুমায়ূনের সবচেয়ে বড় অনন্যতা যে, তিনি একঝাঁক মৃদু মানুষের হাহাকার পাঠককূলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ফাইল ছবি

মোটা দাগে এই ছয়টি গুণ বা বৈশিষ্ট বাংলার লেখককূলেরা আত্মস্থ করতে পারছেন না বলে তাদের পক্ষে আর হ‌ুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। বস্তুত যাঁরা সৃজনশীলতায় বিশ্বাস করেন, তাঁরা জানেন, কোনো সৃজনশীল কাজ অনুকরণ করে আত্মস্থ করা যায় না। এই সত্য বাংলার লেখককূলেরা যতদিন না উপলব্ধি করতে করতে পারবেন, ততদিন তাঁরা শুধু হ‌ুমায়ূন হওয়ার কসরতই করে যাবেন–কোনোদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় হতে পারবেন না।

আর এই ফাঁকে পাঠকেরা হ‌ুমায়ূন আহমেদের কাছেই আশ্রয় খুঁজবেন। যখন রূপার থালার মতো প্রকাণ্ড চাঁদ উঠবে আকাশে, প্রবল জোছনায় ভেসে যাবে চরাচর, গৃহত্যাগী মন ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইবে কিংবা প্রবল বর্ষণে যখন ভেসে যাবে পৃথিবী, একটা কদম ভিজতে ভিজতে একাকী মাথা দোলাবে মৃদু বাতাসে, তখন আমাদের বুকের ভেতরটায় ‘আহা রে আহা রে’ করে উঠবে।

আহা রে! যে মানুষটা এসব চিনিয়েছেন, তিনি আজ নেই! ফিনিক ফোটা জোছনা বৃথাই আলো ছড়ায়। তিনি নেই! তাতে কি? যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততদিন হ‌ুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকবেন।

লেখক: সহসম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন

তারপর কত কত দিন গেল। ঘুরে ফিরে সামনে এল সেই সব মঞ্চ, যেখানে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ অবশ্যপাঠ্য। সামনে এল নিজেরও সেই বয়স, যখন মঞ্চের সামনে থাকা ভিড়ে বা হাজারটা আলাপের ফাঁক গলে ঠিক কানে এসে ঢোকে–‘এখন...
আগামী ৭ এপ্রিল দেশে শুরু হবে ৩ দিনের বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট। রোববার দুপুরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী...
লোডিং...
পঠিতনির্বাচিত

এলাকার খবর

 
By clicking ”Accept”, you agree to the storing of cookies on your device to enhance site navigation, analyze site usage, and improve marketing.