কত অজস্র দুপুর পা দোলায় কষ্ট ফেরিওয়ালার ডাক নকল করে করে। মাল্টিকালার কষ্টের নিচে চাপা পড়া এক কবি তবু মাথা তোলে। ডাকে। কাতরায়। কবিকে দেখি না। এমনকি শ্রবণে আসে না তার কণ্ঠও। তবু তার কবিতা কণ্ঠে তোলা লোক ভীষণ মেকী কষ্টজড়ানো কণ্ঠে কষ্ট ফেরি করে বেড়ায়।
তখন টুইন ওয়ানের সময়। তখন স্কুল। লাল রঙের ক্যাসেট প্লেয়ারে বেজে চলে। আবৃত্তির চিরায়ত ঢঙে একটু টেনে টেনে ভীষণ কষ্ট কষ্ট কণ্ঠে সমস্তটা উজাড় করে দিচ্ছেন আবৃত্তিকার। কিন্তু কোথায় যেন একটা খাদ থেকে যায়। কোথায় গিয়ে যেন মনে হয়, না কবির ধামায় থাকা আসল ও অকৃত্রিম কষ্টের গল্পটাই যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে। নাকি কবি নিজেই একান্ত সম্বল হিসেবে রেখে দিয়েছেন সেই কষ্ট, যা ফেরি করা যায় না?
ঢাকার রাস্তায়, মহল্লার গলিতে তখন ফেরিওয়ালাদের যুগ। এখনকার মতো ভ্যান নয়, বেশ বড় করে ডাক ছেড়ে আসেন জাদুকরেরা। এই শাক, এই ইলিশ, এই সিট কাপড় ইত্যাদি তখন ভোর থেকে সন্ধ্যার গল্প। সে অন্য আলাপ। আমরা তখন এই ডাকের সাথে নিজেদের মনকে বেঁধে রাখি। সেই ডাকের মাঝখানে বড় সসংকোচ ঋজুতা নিয়ে যেন ঢুকে গেল কষ্ট ফেরিওয়ালা। আমরা ভাবতে বসলাম-কেমন হবে তার ডাকটি?
তারপর কত কত দিন গেল। ঘুরে ফিরে সামনে এল সেই সব মঞ্চ, যেখানে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ অবশ্যপাঠ্য। সামনে এল নিজেরও সেই বয়স, যখন মঞ্চের সামনে থাকা ভিড়ে বা হাজারটা আলাপের ফাঁক গলে ঠিক কানে এসে ঢোকে–‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। আর এ এমন এক ফুসমন্তর যে, নড়ে উঠতে হয়। কৌতুক ও উচ্ছ্বাসের ফাঁকে, আপনমনে দুঃখবিলাসের ফাঁকে, হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বসে এই সম্পাদকীয়।
কিন্তু জীবন তো হুল্লোড়ময়। জীবন তো বসেও থাকে না। চলে। চলতেই থাকে। আর আবিষ্কার করে ‘নতুন সব ছোট ছোট নরক’। এই সব নরকের পাশ ঘেঁষেই চলে নিত্য যাতায়াত।
হেলাল হাফিজ এই নিত্য যাতায়াতের ফাঁকে গভীর প্রেমের দাবিতে খুনি হওয়ার মন্ত্রণা দেন হয়তো, কিন্তু ভোলেন না প্রেম। বুঝতে বাকি থাকে না–অনুরাগীরা তাঁর স্লোগানমুখর কবিতাকে কণ্ঠে তুলে নিলেও তিনি আছেন কবি‑ধর্মেই। সে হলো প্রেম।
‘ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।’
একদম দ্বিধাহীন ঘোষণা। নিজের সব ক্ষয়, সব যন্ত্রণা, সকল অবহেলাকে সঙ্গে নিয়ে অনেকটা অনাহুতের মতোই তিনি ঢুকে পড়েছিলেন আমাদের বৈঠকখানায়, শোবার ঘরে এমনকি পার্কের বেঞ্চের ফাঁকা জায়গাটিতে, চলতি পথের ভিড়ের ভিতরে শুধু এটুকু বলতে যে, ভালোবাসি'।
মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ। যে জলে আগুন জ্বলে। ব্যাস। তুমুল জনপ্রিয়তা। বই হয়ে বের হওয়ার আগেই তাঁর কবিতা দেয়ালে সাঁটা হয়ে গেছে। মানুষের মুখে মুখে, তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত নারীদের মনে ও মগজে তাঁর নাম খচিত হয়ে গেছে কবি নামে। তিনি সেই খ্যাতির পথ ধরে কত দূর কোথায় গেছেন, সামনে পাতা সিঁড়ির ধাপগুলো ঠিক কতটা ওপরে বা নিচে নেমে গেছে, সে আলোচনা কবির জীবন নিয়ে যারা কাজ করবেন, তাঁরা করবেন।
কিন্তু কবি আমাদের কী করে গেছেন? হ্যাঁ দীর্ঘদিন নতুন কোনো কবিতা উপহার না পেলেও আমাদের চলে গেছে। হ্যাঁ, এই উথাল-পাথাল দেশের রাজপথ মিছিল ও গুলিতে বারবার হয়রান হলেও শুধু ওই মিছিলে যাবার তার ‘শ্রেষ্ঠ সময়’ অংশ নিয়েই আমরা তৃপ্ত থেকেছি। কিন্তু কোনো এক শীতরাতে তারও চেয়ে বেশি শীতার্ত হৃদয় নিয়ে ঘোলা আকাশে তাকিয়ে থেকে থেকে আমরা স্বগতোক্তির মতো বলে উঠেছি–কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না/ কেউ জানে না। নিজেদের প্রলম্বিত দিন ও রাতের কার্যকারণ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ অলক্ষ্যেই প্রশ্ন ছুড়েছি–কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না। অথচ কবির মতো এই আমাদের বুকের ভেতরেও জন্মাবধি এক রঙিন পাখি ডেকে চলে, যার ধ্রুপদি ডাককে অবজ্ঞা করাই যেন দস্তুর।
ফলে আমরা আমাদের চোখের সামনেই দেখি সমস্ত প্রেম পায় দলে চেনা মুখগুলোকে বিছিয়ে দিতে ভাঁওতার পাটাতন। প্রণয়, যা মানব-মানবী যেমন, দেশেরও তেমন, মাটিরও তেমন, তার দামকে দেখি শুধু কমে যেতে। প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় পিলারকে দেখি ছোট হয়ে আসা আকাশটাকেও ঢেকে দিতে। আমরা দেখি মানুষ নিউট্রন বোমা থেকে শুরু করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তক সব বুঝে গেলেও আজও মানুষ বুঝল না। মানুষ ধারণা ও ধরন সব বিচারেই আজও প্রান্তিক। হেলাল হাফিজ কেন, জগতের তাবৎ কবির তরফ থেকে ছড়ানো প্রেমও তার শুশ্রূষা করতে পারল না।
মানুষ অসভ্য মানুষ খুঁজতে ছুটে গেল আমাজনতক। এই তো কিছুদিন আগে আমাজনের গহীন অরণ্যে আজও টিকে থাকা কিছু মানুষকে শনাক্ত করল, তারপর প্রচার করল-ওরাই বোধ হয় ক্যানিবাল। মানুষখেকো। আহা। অথচ একবারের জন্যও আমেরিকাসহ বিশ্বের স্বঘোষিত পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর অস্ত্রাগারে ক্যামেরা ফেলে বলতে পারল না–ওরাও মানুষখেকো। এই দৃশ্যেই হেলাল হাফিজ ঢুকে পড়েন, বলেন-‘নিউট্রন বোমা বোঝ/ মানুষ বোঝ না! ঠিক এই দৃশ্যেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান উৎপল দত্তও। আগন্তুকের দৃশ্যের ভেতরে চোখ বড় বড় করে বলছেন–সভ্য কারা জানেন? যারা আঙুলের এক টিপে একটি ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে সমস্ত অধিবাসীসহ একটি শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।... যারা এই অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত দিতে পারে। কেমন মিলে যায়। কোথায় যেন উৎপল দত্তের বড় চোখের সেই অভিব্যক্তির সাথে মিশে যায় হেলাল হাফিজের মৃদু কিন্তু ঋজু প্রশ্নসূচক বিস্ময়। দুজনই আমাদের আস্বস্ত করেন। তাও ক্ষণিকের জন্য। কারণ সময় কোথায়? কত কাজ আছে! ওই তো চলে যায় প্রকল্প ও অমরত্ব, চলে যাচ্ছে লাইক, লাভ, ওয়াওসহ বিচিত্র সব ইমোটিকন, যা কিনা আবার আমাদের লাইফলাইন। চলে যাচ্ছে মোহর, মোহর এবং মোহর। অক্ষত পা নিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের প্রতিপক্ষরা, যারা আজ শত্রু হিসেবেই স্বীকৃত। এমন প্রেম ও অপ্রেম, সভ্য ও অসভ্য সম্পর্কিত আলাপের ফাঁদে নিজেকে জমা রাখলে, কোথাও যে কিছু আর জমবে না। মানুষ হয়ে মানুষের চোখে তাকালে শুধু ল্যাঙের জন্যই বেড়ে ওঠা আমাদের বিসদৃশ ঠ্যাঙের আর কী সার্থকতা থাকে! তাই আমরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই প্রতিপক্ষমাত্রই ল্যাঙ মারি। এ আমাদের প্র্যাকটিস।
আমাদের আর নীরব মুহূর্ত নেই। নেই কোনো অহেতু দীর্ঘশ্বাসের জন্য সঞ্চিত কোনো শ্বাসও। ফলে আমরা ছুটি। সকালের আলাপ বিকালের চলতি হাওয়ার ফিল্টারে ফেলে হালনাগাদ করে নিই। আমরা আর বুকের ভেতর ব্যাকুল আগুন পুষি না। যারা পুষতেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন একে একে হেলাল হাফিজের মতো শুধু এই বলে-
‘আমি তো গিয়েছি জেনে প্রণয়ের দারুণ আকালে
নীল নীল বনভূমি ভেতরে জন্মালে
কেউ কেউ চলে যায়, চলে যেতে হয়
অবলীলাক্রমে কেউ বেছে নেয় পৃথক প্লাবন,
কেউ কেউ এইভাবে চলে যায় বুকে নিয়ে ব্যাকুল আগুন।’
আমরা আর কী-ইবা করতে পারি। তাকে, তাদের চলে যাওয়া দেখি। কেমন সটান চলে যাওয়া পথের মাঝ বরাবর তাঁরা হেঁটে যাচ্ছেন। একটু কি কুয়াশা আছে? একটু কি আলো-ছায়া? একটু কি অহেতুক অনিশ্চয়তার কোনো আপতন আছে? হতে পারে। এমন দৃশ্যে এমনটাই দস্তুর। নীল নীল বনভূমি, আর ব্যাকুল আগুন নিয়ে তারা সব চলে যান। আমরা বসে থাকি। আমাদের প্রায় বসে যাওয়া কানে হঠাৎ কোন সুদূর থেকে ভেসে আসে ডাক-কষ্ট নেবে কষ্ট...। কষ্টের সাজানো ডালির বর্ণনা, তাদের নাম আমাদের সচকিত করে, নাকি করে না। আমরা মাল্টিকালার কষ্টের দিকে তাকিয়ে সাদা কষ্টকে পাশ কাটাই, আমরা লাল কষ্টকে ঢেকে দিই নীল কষ্ট দিয়ে। এভাবে এক কষ্ট থেকে আরেক কষ্টে আমরা ছুটে বেড়াই। তবু ফেরিওয়ালার না বলা সেই কষ্টের কথা আমরা ভুলতে পারি না। আমাদের মন খচখচ করে। মনে হতে থাকে কোন এক কষ্টের কথা না বলেই, আমাদের ঝাঁপি খুলে না দেখিয়েই ফেরিওয়ালা চলে যাচ্ছেন, কবি চলে যাচ্ছেন। হাফিজ, প্রিয় হেলাল হাফিজ ঠিক কী লুকালেন?
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]