১৯৪৭ সালে ভারতের সংবিধানের যে সকল খসড়া তৈরি করা হয়েছিল এবং তা গৃহীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানে ভাষা‑সংক্রান্ত কোনো ধারা রাখা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা হলে বিতর্ক অনিবার্য হয়ে পড়ত। সেক্ষেত্রে হিন্দি ভাষাকে অজস্র ভাষাভাষীদের ওপর চাপানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠত। হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষায় পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না বিবেচনা করেই রাষ্ট্রের ভাষা প্রসঙ্গে কংগ্রেস কোনো ধারা না রেখে কৌশল অবলম্বন করেছিল।
সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস দলের বৈঠকে হিন্দি ভাষা‑সংক্রান্ত যত বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, তত বিতর্ক আর কোনো ধারা নিয়ে করেনি।’ যদিও সংবিধান সভায় কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা ছিলেন নেহেরু, সর্দার প্যাটেল মনোনীত ব্যক্তি। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষার ভিত্তিতে সরকারি ভাষা নির্ধারণ করা হয়েছিল। হিন্দি ও বাংলা ভাষার কোনটি সরকারি ভাষা হবে–এ নিয়ে সংবিধান সভার ভোটাভুটিতে হিন্দির পক্ষে ৭৮ ভোট এবং বাংলার পক্ষে ৭৮ ভোট পড়ে। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় দফায় আবার ভোটাভুটি হয়। এবং ওই ভোটাভুটিতে হিন্দির পক্ষে ৭৮ ভোট এবং বাংলার পক্ষে ৭৭ ভোট পড়ে। মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি জয়ী হয়। বাংলা ভাষার এক ভোটে পরাজয়ে ভূমিকা পালন করেন সাহিত্যিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কারণেই বাংলা ভাষা ভারতের সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করতে পারেনি।
দলীয় নির্দেশ এবং সংবিধান সভার শৃঙ্খলা মেনে কংগ্রেস দলীয় সদস্যরা হিন্দি ভাষার পক্ষে ভোট দেন। কংগ্রেস দলের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রবীণ সদস্য মহারাষ্ট্রের শঙ্কর দেও সংবিধান সভায় বলেছিলেন, ‘আরএসএস [কট্টর হিন্দুত্ববাদী] সংগঠনের প্রধান সংস্কৃতর নামে আবেদন করেছিলেন।’ ভবিতব্য এই যে, কতিপয় কংগ্রেস সদস্যও সংস্কৃতের নামে আবেদন করেছিলেন। বিতর্ক-বিভক্তির আশঙ্কা অমূলক ছিল না। হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রের সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ফলে দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলে সংখ্যাগরিষ্ঠ অহিন্দিভাষীরা। আন্দোলন ক্রমেই সহিংস ও সংঘাতে বিষ্ফোরিত হলে কংগ্রেস সরকার পূর্ববৎ ইংরেজি ভাষাকে অহিন্দি প্রদেশে বহাল রাখতে বাধ্য হয়। রাজ্যের জনগণ যাতে ইংরেজির স্থলে ভবিষ্যতে হিন্দি গ্রহণ করতে পারে, তার দুয়ারও উন্মুক্ত রাখা হয়।
যে কংগ্রেস স্বাধীনতার পূর্বে দাবি করেছিল ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশসমূহের পুনর্গঠন। অর্থাৎ, প্রদেশের জনগণের ভাষায় প্রশাসনিক কার্য চালিয়ে প্রশাসনকে জনগণের নিকটবর্তী করে তোলা। অথচ স্বাধীনতার পর এবং ক্ষমতা প্রাপ্তিতে সে অবস্থান থেকে সরে আসে। প্রকৃত অর্থে ভারতে ভাষার প্রশ্নে মীমাংসা না হবার ফলে জাতীয়তার সংকট এবং এ নিয়ে অজস্র সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল, যা আজও চলমান। এর জন্য বিভিন্ন ভাষাভাষীদের ত্যাগ-আত্মত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। ভাষাভিত্তিক প্রদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে মারাঠা-কন্নড়, বিহার-পশ্চিমবঙ্গ, আসাম-নাগাল্যান্ড, পাঞ্জাব-হরিয়ানা ইত্যাদি প্রদেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। এমনকি বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী সংখ্যালঘু ভাষাভাষীরা ভাষিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল। মাতৃভাষার ব্যবহার, মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ নিয়েও ঘটেছিল অনভিপ্রেত অসংখ্য ঘটনা।
জাতিগত সংঘাত সেই যে সৃষ্টি হয়েছিল, তার আর অবসান হয়নি। আসামে বাংলাভাষী, কর্নাটকে বেলগাঁও, কারওয়ারে মারাঠীভাষী, বিহারে বাংলাভাষী ইত্যাদি। আসাম প্রদেশে ‘বাংলা খেদা’ আন্দোলন নতুন নয়। অতীত আমল থেকে সৃষ্ট ওই সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং ক্ষমতাসীন শাসকেরা নতুন নতুন বিষয় যুক্ত করে অসমীয়া-বাঙালি বিরোধকে উসকে দিয়েছে। প্রয়াত রাজীব গান্ধীর আমলে ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চুক্তির ভিত্তিতে আসামে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) প্রস্তুত ও তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস অসমীয়াদের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভের অভিপ্রায়ে। আর বর্তমান বিজেপি সরকার ক্ষমতা লাভের পর এনআরসি সংসদে তুলে বিল পাস করিয়ে জাতীয়তার বিরোধের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক বিরোধকে চরম পর্যায়ে ঠেলে দিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এনআরসি, সিএএ এখন ভারতজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, অগণিত মানুষকে ক্যাম্পে বন্দিদশায় আটক করেছে। চলছে ‘বহিরাগত’ অভিধায় দেশ থেকে বিতাড়িত করার নানা আয়োজন। সেটি সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু করেছেন। আমেরিকা হাতকড়া পরিয়ে অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের ভারতে ফেরত পাঠিয়েছে, নিজ দেশের বিমানে।
আসামে ১৯৫০, ১৯৫৫ সালে বাংলাভাষী বিতাড়নে দুই দফায় দাঙ্গা হয়েছিল। ১৯৬০ সালে তার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাঙালিদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তির ক্ষতি-বিনষ্ট, লুঠতরাজ, শারীরিক লাঞ্ছনা, হত্যা, বাঙালি নারীদের শাড়ির স্থলে মেখলা পরিধানে বাধ্য করা, শাখা-সিঁদুর ব্যবহারে বাধা দেওয়া, নারী-ধর্ষণের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছিল। বাঙালিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের বাঙালি-অসমীয়া দাঙ্গা ছিল জাতিগত বিদ্বেষপ্রসূত। সাম্প্রতিক সময়ে আরও নৃশংস রূপে সাম্প্রদায়িক হানাহানি-দাঙ্গা সংঘটিত হচ্ছে।
আসাম রাজ্যে অসমীয় ভাষাকে একমাত্র ভাষা ঘোষণা করার ফলে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বাঙালি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বাঙালিদের দাবি ছিল অসমীয় ভাষাকে পরিত্যাগ নয়, অসমীয় ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার। অনেকটা পাকিস্তানি রাষ্ট্রে একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্রভাষার বিপরীতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামের অনুরূপ। আসামে অসমীয় ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে প্রদেশের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবি তুলেছিল বাঙালিরা। সাবেক পূর্ব বাংলায়ও ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার দাবি তুলে।
আসাম ও পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের দাবির সাদৃশ্য রয়েছে। আসামে ভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হয়ে পড়ায় প্রদেশের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকার অসমীয় জাত্যভিমানকে নিজেদের পক্ষে পাওয়ার অভিসন্ধিতে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র পন্থায় দমনে অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেল স্টেশনে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি-বর্ষণ করে। এতে নারীসহ ১১ জন ভাষা আন্দোলনকারী প্রাণ হারায়।
অসমীয়রা দাবি করে আসাম রাজ্যের ও অসমীয় ভাষার তারা আদি জাতি। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাস হচ্ছে বার্মার শান-রাজ্য থেকে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, ডিঙিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রবেশ করেছিল অহোমদের আদি জাতি। এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল না। প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী ছিল। কালক্রমে এদের চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতা, আচার-আনুষ্ঠানিকতা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তনে এরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে এবং নিজেদের আদিভাষীরূপে ভাবতে শেখে। তিন-চার শ বছরের ব্যবধান এরা নিকটবর্তী ভারতীয় লোকাচার-সংস্কৃতি অনুসরণ করে স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতির আচার গড়ে তোলে। আসামের ভাষা সংঘাত সমাধানে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘অ’ মোর চিকুনি দেশ বইতে লিখেছেন, ‘আসামকে অবিভক্ত রেখে সেখানকার মাইনরিটির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে এমন এক মীমাংসা সূত্র আবিষ্কার করতে হবে, যেটা আসামের বাইরেও প্রযোজ্য। আসাম এ বিষয়ে সৃষ্টি ছাড়া নয়। অন্যত্র একই সমস্যা। কোথাও কম, কোথাও বেশি। অসমীয়া জাতিগোষ্ঠীকে মেজরিটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়।’
সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের ওপর হিন্দি ও দেবনাগরী লিপিকে চাপিয়ে দেবার অভিযান মুসলমানদের, বিশেষ করে উত্তর ভারতের উর্দুভাষী মুসলমানদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল। তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি এতে বিপন্ন হয়ে পড়বে। ১৯৩৭ সালে অক্টোবরে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে এম এ জিন্নাহ জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেবার তীব্র নিন্দা করেন। কংগ্রেসের হিন্দি ভাষার প্রতি পক্ষপাতিত্বে মুসলমানদের মনে সেই যে সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছিল, সেই বীজ ডাল-পালা ছড়িয়ে পরবর্তীকালে দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতির সচিব সি এস ভেঙ্কটাচার লিখেছেন, ‘হিন্দি ভাষার প্রশ্নে চরমপন্থার অশুভ তাৎপর্য মুসলিম সম্প্রদায়কে যথার্থই আতঙ্কিত করেছিল। মুসলমানেরা উপলব্ধি করেছিল তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন। এই বিশ্বাস দ্রুত মুসলমান সম্প্রদায়ের মনের ওপর অবাঞ্চিত হস্তক্ষেপেই পাকিস্তান সৃষ্টিতে এটি অন্যতম মুখ্য কারণ হয়েছিল।’
ভাষার দ্বন্দ্বে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বিভক্তি সাম্প্রদায়িক বিভক্তিরই আরেক অনুষঙ্গ। অপরিণামদর্শী দেশভাগ, রক্তাক্ত দাঙ্গা, উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের ট্রাজেডি আজও উপমহাদেশের সর্বাধিক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষা চাপানো সম্ভব হয়নি। ত্যাগ-আত্মত্যাগে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। অথচ বৃহৎ ভারতে দক্ষিণ ভারত ব্যতীত সকল জাতিসত্তার ভাষাকে কোণঠাসা করে হিন্দির একক আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী উন্মেষকে নিষ্ঠুর হস্তে দমন-পীড়নে স্তব্ধ করা হয়েছে, বারংবার-বহুবার। জাতিসত্তার আন্দোলনকে আখ্যা দেওয়া হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিধায়। স্বীকার করতে হবে সমগ্র ভারত হিন্দির আগ্রাসনের কবলে। এমনকি আমাদের দেশেও হিন্দি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রযুক্তির বদৌলতে। বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক মোরেস বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের ঐক্য যদি কৃত্রিম ছিল তো ভারতবর্ষের দেশভাগও তাই। ভারতবর্ষকে যদি বিভক্তই হতে হয়, তবে জনতত্ত্বগত এবং সাংস্কৃতিক সংহতি ও ভাষার ভিত্তিতে যুক্তিসম্মতভাবে ভাগ হওয়া উচিত ছিল।’
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]