দেশটায় এখন প্রচুর ঘটনা। একটার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটা ঘটে যায়। এরপর আরেকটা। এভাবে চলছেই কেবল। তবে সব ঘটনার পরম্পরা একে একে সাজালে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। আর তখনই মনে পড়ে ১০ বছর আগে মুক্তি পাওয়া এক বাংলা সিনেমার কথা। সেই সঙ্গে উঁকি দিয়ে টুকি দিয়ে যায় কাক ও কোকিল!
প্রথমে না হয় বাংলা সিনেমার দিকেই চোখ দেওয়া যাক। ‘তোকে ভালবাসতেই হবে’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রায় ১০ বছর আগের ছবি। কিছুদিন আগেও সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিত মুখ জায়েদ খান ওই সিনেমায় নায়ক হিসেবে ছিলেন। নায়িকা হিসেবে ছিলেন কিছুটা স্বল্প পরিচিত সাহারা। সিনেমার নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভালোবাসাটা আসলে অনেকটা দাবির দিকেই চলে গেছে এতে! মানে অনুভূত হোক না হোক, ভালোবাসতেই হবে।
কাহিনী সংক্ষেপ এবার জানা যাক। খুব একটা অপরিচিত নয়। মোটামুটি এ দেশের ঢালিউডের ৫টা বাণিজ্যিক ঘরানার বাংলা সিনেমাও যারা দেখেছেন, তারাও আন্দাজ করে নিতে পারবেন। গল্পের শুরুটা কাজল ও রাজু’কে নিয়ে। তাদের দেখা হয় এক সিনেমা হলে। বড়লোকের মেয়ে কাজল, আর বড়লোক নয় রাজু। এই এই, বুঝে ফেলেছেন না কিছুটা? বাকিটা বলি। গরিব–বড়লোক যখন চলেই এল, তখন একটা দ্বন্দ্ব তো লাগেই। তো, কাজল ও রাজুর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব শুরু হয় পুরো হল ভাড়া করে সিনেমা দেখা নিয়ে।
আরও পড়ুন:
দলবল নিয়ে কাজল সিনেমা দেখতে গেলে তাতে বাধা দেয় রাজু। রাজুও তার দলবল নিয়ে আসে। এরপর এক পর্যায়ে কাজল জানতে পারে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাজু অভিযান চালায়। শুনেই প্রেম উড়ে এসে জুড়ে বসে কাজলের মনে এবং বলে, ‘প্রেজেন্ট, ম্যাম’! আর সেই ভালোবাসাকে পূর্ণতা দিতে কঠিন লড়াই করতে হয় দুজনকে। এই কঠিন লড়াইয়ের ফলাফল হলো—‘তোকে ভালবাসতেই হবে।’ এই সিনেমার পরিচালক ছিলেন রাজু চৌধুরী। তবে গল্প কিংবা সিনেমার দৃশ্যের চেয়ে মজার ছিল সিনেমার নামের ইংরেজি সংস্করণ। সেটি ছিল, অন্তত পোস্টার অনুযায়ী, ‘BY FORCE LOVE’!
অর্থাৎ, জোর করে হলেও ভালোবাসা আদায় করে নেওয়াটা এই সিনেমার নামগত মূল উপজীব্য। এ কারণেই বোধহয় সিনেমার পোস্টারে ভালোবাসা শব্দটির মধ্যে ল–এ ও–কার দেওয়াও হয়নি। যেহেতু ফোর্সের ব্যাপার আছে, তা একটু অদল–বদল তো হতেই পারে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই জোর করে ভালোবাসার বিষয়টাকে জাতীয়ভাবেও অনুভব করার সুযোগ আছে। এই দেশে শাসক বা শাসক দল বা জোটবদ্ধ কতিপয় কথিত জনগোষ্ঠী সর্বদাই এমন ‘BY FORCE LOVE’কে আঁকড়ে ধরে থাকে। সবার কথা একটাই, তারা যেটা বলবেন, সেটাকে বিশ্বাস করতেই হবে। এর পাল্টা কথাও বলা যাবে না, পাল্টা ধারণাও আনা যাবে না। আনলেই দেখা যায়, ঠেলতে ঠেলতে কোণঠাসা করে ফেলা হয়।
অথচ ভালোবাসাটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। সেটি মানব–মানবীর মধ্যেই হোক, বা জাতীয় পর্যায়েই হোক না কেন। এটি কখনও জোর করে আদায় করা যায় না। বরং এটিকে স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হওয়া বা প্রবাহিত হতে দেওয়াই ভালো। যে অনুভব করার, সে করবে। আর যে করবে না, তাকেও স্বাগত জানানো প্রয়োজন। তাহলেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকে। আর এতে করে হানাহানি এবং অহেতুক দ্বন্দ্বও কম হয়। সবার আগে তো জীবনে শান্তি প্রয়োজন, নাকি?
আরও পড়ুন:
কিন্তু এই সরল ও সাধারণ বিষয়টাই আমরা জাতিগতভাবেই যেন বুঝতে অক্ষম। তাই বার বার তৈরি হয় ‘তোকে ভালবাসতেই হবে’ শীর্ষক অবস্থা। সিনেমার পর্দায় জায়েদ খান সফল হলেও, বাস্তবতা আর সিনেমা সমার্থক নয়। এতে মিলও খুব একটা থাকে না। জায়েদ খানকে রুপালি পর্দায় সফল হতে দেখে তাই যে কেউ নতুন বাণী দিয়ে তা মানার জন্য বলতেই পারেন যে, ‘তোকে ভালবাসতেই হবে’! কিন্তু মনে রাখতে হবে বাস্তব দুনিয়ারা সাহারা’রা সব সময় তা নাও মানতে পারে।
আর এই জায়গাতেই এসে যায় কাক–কোকিল সমাচার। কোকিল ডিম পাড়ে কাকের বাসায়। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে, কোকিলের বাসা বাঁধার প্রবণতা নাকি কম। মেয়ে কোকিলেরা ডিম পাড়ার আগে বাসার খোঁজ করে। দেখে নেয়, কোনো কাকের বাসায় সম্প্রতি ডিম পাড়া হয়েছে কিনা। তেমনটা পেলে সেই বাসায় গিয়ে ডিম পেড়ে আসে। এ নিয়ে কাকের সঙ্গে কোকিলের নাকি ঝামেলাও হয়। তাই কোকিলেরা কিছুটা ছল করেই ডিম পাড়ে কাকের বাসায়।
তবে কাকের বাসায় ডিম পাড়লেই কোকিলের বাচ্চা কাকের বাচ্চা হয়ে যায় না। ডিম ফুটে বের হওয়ার পর কোকিলের বাচ্চা কোকিলই হয়, কাক নয়। এখানে কাককে আসলে বোকা বানানো হয়। মাঝখান দিয়ে কাকের কাছ থেকে ফ্রি’তে ডে–নাইট কেয়ার সার্ভিস নিয়ে নেয় কোকিল। কাক আর কী করবে? কা কা করেই দিন কাটায়!
এমন অবস্থা এ দেশেও পাবেন ঢের। এখানে অবশ্য কে কাক, আর কে কোকিল—সেটি বোঝাই দুষ্কর। আমাদের দেশে কাকের বেশে কোকিল থাকে, আবার কোকিলের বেশে কাকও থাকে। চিনতে হলে তাই তাদের মুখ ঠিকমতো খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়। যদিও এ বঙ্গে কাক ও কোকিল পরস্পরের ডাকও নকল করতে শিখে গেছে কিনা, সেটিও গভীর গবেষণার বিষয়। তবে এ নিয়ে সমাধান হওয়া এখন আর সম্ভব নয়। কারণ গবেষণা বলতে জাতিগতভাবে আমরা সিংহভাগই গরু খোঁজাই তো বুঝি!
আরও পড়ুন:
তাই দিনশেষে আমরা একেক সময় একেক পক্ষের একই হুমকিস্বরূপ অনুরোধরূপী আদেশ শুনেই যাই। সেসব পক্ষ কেবলই বলতে থাকে—‘তোকে ভালবাসতেই হবে’। আর আমজনতা কেবলই সেই ‘ভালবাসা’র ল–এ ও–কার খোঁজে!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]
মতামত থেকে আরও পড়ুন: