রমজান মাস চলছে, ৭ দিন পারও হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে চলে আসছে ঈদের প্রস্তুতি। প্রতি ঈদেই রাজধানী ঢাকা প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে। আর এমন শহরে স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থাকেই। এটা গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা শহরের রীতিই হয়ে গেছে বলা চলে। এমন পরিস্থিতিতে যাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব, তাদের কাছ থেকেই কিছুটা ভিন্নধর্মী নির্দেশনা পাওয়া গেল এবার!
সদ্যই ঈদের সময়কার নিরাপত্তা নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ‘তারাবির সময় আপনারা মসজিদে দেড়-দুই ঘণ্টা থাকেন। সেই সময় রাস্তাঘাটে লোকজন কম থাকে। এই সময় আপনাদের বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান একটু সযত্নে রেখে আসবেন। নিরাপত্তাটা খেয়াল করবেন।’
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ‘আমি আশা করছি, ১৫ রমজানের পরে ঢাকার অনেক মানুষ নিকট আত্মীয়দের সাথে ঈদ উদযাপন করতে চলে যাবেন। আমি পুলিশ কমিশনার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে জানাতে চাই, আপনাদের অনুরোধ করতে চাই, দয়া করে আপনারা যখন বাড়ি যাবেন, তখন বাড়ি, ফ্ল্যাট-দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এটির একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিজ দায়িত্বে করে যাবেন। আমরা আপনাদের সাথে আছি।’
প্রথমে ইতিবাচক দিকটির প্রতি মনযোগ দেওয়া যাক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিনিধি হিসেবে কমিশনার সাহেব আমাদের আশ্বস্ত করেছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। তিনি বলেছেন যে, পুলিশ ঢাকাবাসীর সাথে আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি সত্যিই স্বস্তির কথা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) বা অন্য যেসব সংস্থা নানা অপরাধের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে, সেগুলোতেই স্পষ্ট যে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনমন ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। বেড়েছে ছিনতাই, রাহাজানিও। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি বেড়েছে, সেটি হলো নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি এবং এ সংক্রান্ত উদ্বেগ ও আশঙ্কা।
বাংলাদেশের পুলিশের দেওয়া ক্রাইম স্ট্যাটিসটিক্স অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে নানা ধরণের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মোট ৪ হাজার ৪৬১টি। ওই মাসে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ৬২২টি। অপরাধে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর। মোট রেঞ্জ আছেই ৯টা। এর মধ্যেই ৫টাতেই দেখা যাচ্ছে বাড়বাড়ন্ত। আর নতুন বছরের প্রথম মাসে সারা দেশে মোট মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৭২টি। মোট অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ৪ হাজার ৬৯২টি। অপরাধের সংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রেঞ্জগুলোর মধ্যে কেবল খুলনা ছাড়া আর সবগুলোতেই সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। বেড়েছে ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, খুন, অপহরণ, চুরি ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের অপরাধই। পুলিশের নিজেদেরই দেওয়া এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা যায় যে, অপরাধের সংখ্যা বেড়েছেই, কমেনি।
তো, এমন পরিস্থিতিতে ডিএমপি যখন নগরবাসীর সাথে থাকার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন, তখন স্বস্তি আসার কথা বৈকি। কিন্তু এর আগের কথাগুলোই কেমন যেন অস্বস্তির দোলা দিয়ে যায়। কর্তৃপক্ষীয় অবস্থান থেকে এমন বক্তব্য এর আগেও শোনার অভ্যাস নগরবাসীর হয়েছে। এক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একবার নগরবাসীকে শুনিয়েছিলেন বাসায় তালা লাগানোর নসিহত। আরেক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবার খুনের ঘটনায় পক্ষান্তরে দিয়েছিলেন মেনে নেওয়ার নিদান। এসব শুনে পচে যাওয়া কানে এবার এল ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগে নিজ বাসার নিরাপত্তা নিজ দায়িত্বে নিশ্চিত করে যাওয়ার আহ্বান!
স্বাভাবিকভাবেই মহানগরীর কিছু নিজস্ব নিয়ম থাকে। মহানগর বা মেট্রোপলিটন সিটি খুব ব্যস্ত একটি স্থান, প্রকৃতিগতভাবেই। তবে এই স্থানে যেমন মানুষের ভিড় বেশি থাকে, তেমনি বিভিন্ন নাগরিক সুযোগ–সুবিধাও বেশি থাকার কথা। সারা বিশ্বের মেট্রোপলিটন সিটির ধরন এমনই। অবশ্য আমাদের দেশের মেট্রোপলিটন সিটিগুলোতে কেবল মানুষের ভিড়ই দেখা যায়। সুযোগ–সুবিধা সেভাবে মেলে না বলে অনুযোগ বিদ্যমান। তারপরও এ ধরনের শহরগুলোতে বাস করা অস্থায়ী নাগরিকেরা আবাস ছেড়ে কিছুদিনের জন্য শহরের বাইরে গেলেও কিছু নিয়ম মেনেই যান। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্তত দরজা–জানালা বন্ধ করে, ভালো করে তালা লাগিয়েই বের হন। ঘরের সদর দরজা হাট করে খুলে দিয়ে সাধারণত কেউ বের হয়ে যায় না। তারপরও শহরগুলোয় চুরি–ডাকাতি হয়। আর সেগুলো ঠেকানোর জন্যই থাকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এখন তাদের পক্ষ থেকেই যদি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার আগে নিজ বাসার নিরাপত্তা নিজ দায়িত্বে নিশ্চিত করে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয় নাগরিকদের প্রতি, তাহলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় কী?
নাগরিকেরা যে ধরনের নিরাপত্তাবিষয়ক পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করার, সেগুলো তো করবেই। কিন্তু নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরই। এই নিশ্চিত করার কাজটি কখনোই নাগরিকেরা করতে পারবে না। এটি করা তাদের পক্ষে সম্ভবও না। কিন্তু ডিএমপি কমিশনার তো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ‘নিজ দায়িত্বে’ করার কথা বলছেন! আবার সাথে থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করছেন। তাহলে নাগরিক হিসেবে আমাকেই যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ‘নিজ দায়িত্বে’ করতে হয়, তাহলে বাহিনীগুলো কি করবে? এই ‘সাথে থাকা’ লইয়া আমরা কি করিব?
ভিডিও দেখুন:
সোজাসাপটা কথা হলো, সরকারের কাছ থেকে কিছু নাগরিক সুবিধা পাওয়ার নিমিত্তেই নাগরিকেরা নানামাত্রিক কর দেন। এসব প্রাপ্য সুবিধাদির মধ্যে নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। তার জন্যই কর জমা হয় সরকারের কোষাগারে এবং সেখান থেকে সকল ধরনের সরকারি কর্মচারিদের বেতনও হয়। সুতরাং নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারেরই, সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোরই। এটি নাগরিকের ‘নিজ দায়িত্বে’ করে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। এভাবে নাগরিকের ‘নিজ দায়িত্ব’ উল্লেখযোগ্যভাবে উল্লেখ করার ফলে এক ধরনের গা বাঁচানো মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।যদিও কর্তৃপক্ষীয় দিক থেকে বরাবরই খানিকটা গায়ের জোরেই বলে দেওয়া হচ্ছে যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি ‘মোটামুটি ভালো’, ‘উন্নতি হচ্ছে’, ‘অনেক ভালো’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু জনাব, বাংলায় একটা ভাবসম্প্রসারণ আছে। সেটি হলো—‘ আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়’। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকেরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নিশ্চিন্ত না হতে পারছেন, সেটি নিয়ে সন্তুষ্টির বিষয়টি অবলীলায় কোনো যদি–কিন্তু ছাড়া প্রকাশ না করতে পারছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে সফলতার পদকটি গলায় পরার উপায় নেই। আর ততক্ষণ পর্যন্ত নাগরিকদের ‘নিজ দায়িত্ব’ নিয়ে বেশি কিছু বলাও আসলে উচিত নয়। এতে উল্টো নাগরিকক্ষোভ তৈরির আশঙ্কাই বেশি।
এর চেয়ে বরং দেশটার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিটা ঠিক হোক আগে। কথার বদলে কাজ হোক। সেটিই হয়তো সকল নাগরিকের একমাত্র চাওয়া!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]