ইংরেজি এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখ। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে এই দিনটিকে ‘এপ্রিল ফুল’ বানানোর সময় হিসেবে পালন করে অনেকে। তবে এটি যে একদম সার্বজনীন কোনো দিবস, তা নয়। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। কেউ পালন করে, কেউ করে না। তবে অনেকে বোকা বনেও যায়। ২০২৫ সালে যেমন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বনে গেল। এবং তার মধ্য দিয়েই এ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর সকরুণ অবস্থাও ফুটে ওঠে।
সংবাদমাধ্যমকে হওয়ার কথা দেশের সবচেয়ে প্রাগ্রসর প্রতিষ্ঠান। তবে বাংলাদেশে তেমন হওয়ার সম্ভাবনাটি ঢের আগেই ‘মরো মরো’ অবস্থায় চলে গেছে। সেই অবস্থারই একটি উদাহরণ হলো এপ্রিল ফুলের দিনে এ দেশের অনেক সংবাদমাধ্যমের ‘ব্যক্কল’ হয়ে যাওয়া। বেয়াক্কেলও বলা যায়। কারণ, পর্যাপ্ত আক্কেলের অভাবেই তো এমনটা হয়েছে।
ঘটনাটি বিস্তারিত জানা যাক। কেমব্রিজ ডিকশনারির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ১ এপ্রিল, ২০২৫ এক ‘বিশেষ ঘোষণা’ দেওয়া হয়। তাতে বলা হয় যে, ‘আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শেয়ার করতে এসেছি। আমাদের কমিউনিটির সদস্যরা সব সময় ইংরেজি বানান নিয়ে সমস্যায় পড়েন, বিশেষ করে “q” অক্ষর দিয়ে বানান করা শব্দগুলোর সঙ্গে। তাই আমরা কেমব্রিজ ডিকশনারি থেকে “q” অক্ষরটি সরিয়ে ফেলব।’ q অক্ষরের পরিবর্তে কোন অক্ষরটি ব্যবহার করা হবে, সেটিও জানিয়ে বলা হয়, ‘বর্তমানে “qu” দিয়ে বানান করা সব শব্দের পরিবর্তে “k” অথবা “kw” দিয়ে বানান করা হবে। উদাহরণস্বরূপ: kwiet, ekwipment ও antike।’ সেই সঙ্গে কেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা ওই পোস্টের প্রথম কমেন্টে দেখতে বলা হয়। সেই প্রথম কমেন্টে মূলত ছিল কেমব্রিজ ডিকশনারির অনলাইন ভার্সনে থাকা ‘এপ্রিল ফুলস ডে’‑এর অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কিত ওয়েবলিংক। আসলে ১ এপ্রিল উপলক্ষে মজার ছলে নেটিজেনদের ‘এপ্রিল ফুল’ বানাতেই কেমব্রিজ ডিকশনারির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ওই পোস্টটি দেওয়া হয়েছিল।
এ নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কেউ এর সমালোচনা করেছেন। কেউ মজাও পেয়েছেন বেশ। অর্থাৎ, নেতিবাচক-ইতিবাচক, দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই পেয়েছে কেমব্রিজ ডিকশনারি কর্তৃপক্ষ। ওই বিশেষ ঘোষণার ফেসবুক পোস্টে পরের ১২ দিনে রিঅ্যাকশন পড়েছে ৪৬ হাজার, শেয়ার হয়েছে ২৪ হাজার। অর্থাৎ, নিখাদ মজা করা বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘ফুটেজ খাওয়া’‑কেমব্রিজ ডিকশনারির সোশ্যাল মিডিয়া টিমের উদ্দেশ্য যা‑ই থাকুক না কেন, সেটি সার্থক হয়েছে।
এর মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম ধরা খেল। কারণ কমেন্টে গিয়ে লিংকে ক্লিক করার সময় আমাদের নেই। তাই এ দেশের পরিচিত অনেক সংবাদমাধ্যমই করে ফেলল একটি সংবাদ। তাতে বলে দেওয়া হলো যে, আসলেই কিউ অক্ষরটিকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। কারও শিরোনাম হলো–‘কেমব্রিজ ডিকশনারি থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কিউ’। কেউ আবার লিখেছে–‘কেমব্রিজ ডিকশনারি থেকে কিউ অক্ষর সরিয়ে ফেলার ঘোষণা’।
পরে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে, অনেক সংবাদমাধ্যমই এই নিউজটি বন্ধ করে দেয়। তবে গুগলে সার্চ দিলে এখনও এসব নিউজের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আমরা আসলে আলোচিত কিছু পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটিকে নিজেদের প্ল্যাটফর্মে প্রচার করে দিতে পারি। আলোচিত কিছুকে অবলম্বন করে আলোচনায় থাকাটাই এখানে মূখ্য বিষয়।

কারণ অনেক। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, সঠিক সাংবাদিকতার জ্ঞান ও নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও পরিপক্ব করার সময় এসেছে। এ দেশে এখন অনেক সরকারি‑বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই সাংবাদিকতা পড়ানো হয়। এর বাইরে আরও অনেক আছেন, যারা এই পেশায় থাকতে থাকতেই সাংবাদিক হয়েছেন। তবে এত কিছুর পরও আমরা কমনসেন্স ও যৌক্তিকতার চর্চা করতে ব্যর্থ হয়েছি। অন্য সব বিষয়ের মতো বাংলাদেশের সাংবাদিকতাও চলে ‘যেদিকে বৃষ্টি পড়ে, সেদিকে ছাতা ধরে’ তরিকায়। বিশেষ করে ডিজিটাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হওয়ার পর থেকে এটি আরও বেশি দৃশ্যমান। কারণ ডিজিটাল মিডিয়ার মূল বিষয়গুলোর অনেক কিছু না বুঝেই যে আমরা এর প্রয়োগে নেমে পড়েছি। ফলে অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। যার ফল এ ধরনের খবর।
এটি ঠিক যে, ফেক নিউজ ও ফেক ছবি-ভিডিওর বর্তমান যুগে ভুয়া কনটেন্ট চিহ্নিত করা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। তাই ধৈর্য্য ধরার কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে আরও বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাও অপরিহার্য। আর সাংবাদিকতার এই সাধারণ কাজগুলোকে আমরা অনেকেই কম গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ আমরা এখন চোখ বুজে ‘ট্রেন্ডিং’ অনুসরণের পথ বেছে নিয়েছি। আর তা করতে গিয়ে তৈরি হয় ‘তাড়াহুড়া’। তাই ডিকশনারি থেকে কিউ অক্ষর সরিয়ে ফেলার মতো নিউজ গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করে শুনতে হয় পাঠক-দর্শকের গালমন্দ। এতটা হেলাফেলা করে সাংবাদিকতা করলে, সেটিই তো প্রাপ্য, নাকি?
যখন কোনো পেশায় এভাবে কাজ করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তখন বুঝতেই হয় যে, সেই পেশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সঠিকতা চর্চার অভ্যাস কমছে। পেশাদারির অভাব প্রকট হচ্ছে। আবার এর গভীরে গেলে আমরা পাব এই পেশায় থাকা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত শারীরিক ও আইনি নিরাপত্তাহীনতা, করপোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাসহ আরও অনেক কিছু। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। আবার একটার ফল হিসেবে আরেকটা তৈরি হয়। আর সবকিছু মিলে এমন এক জট সৃষ্টি করেছে, যার ফল হলো–অনুভূতিহীন প্রক্রিয়ায় মানুষের অনুভূতি জানার জার্নালিজম! এটি দিয়েই আসলে শুরু।
তবে হ্যাঁ, এর মধ্যেও হাতেগোণা কিছু সংবাদমাধ্যম সঠিক সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করছে। তবে সেটিও স্থান, কাল, পাত্র ভেদে আপেক্ষিক আচরণ করে অনেক সময়ে। সুতরাং, একেবারে আদর্শ সাংবাদিকতার দৃষ্টান্ত জাতীয় পর্যায়ে দেখানো বেশ কঠিন।
এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হাস্যরসের আলোড়ন তোলেন ‘সরকার নিউজ এজেন্সি’র হর্তাকর্তা এক সাংবাদিক। এ‑সংক্রান্ত একটি সোশ্যাল কার্ড বেশ আলোচিত হয়েছিল। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদির এক স্থানীয় সাংবাদিক খুলেছেন ‘সরকার নিউজ এজেন্সি’। ওই সোশ্যাল কার্ডে তিনি নিজেকে সাংবাদিকতা সংক্রান্ত অনেক সংগঠনের নেতা হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি মোট ১৬টি সংবাদমাধ্যমে কর্মরত থাকার কথাও প্রচার করেন। সবই মূলত একেবারেই স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। অর্থাৎ, এক সাংবাদিক নিজেই জানাচ্ছেন যে, তাঁর কর্মস্থল ১৬টি সংবাদমাধ্যম! এর মধ্যে একটির আবার তিনি নির্বাহী সম্পাদক, নাম ‘আউচ সংবাদ’!
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সবই সত্য। ‘আউচ সংবাদ’ আছে, তার নির্বাহী সম্পাদকের ‘সরকার নিউজ এজেন্সি’ও আছে। যতটা জানা গেছে, এটি মূলত সাংবাদিক পরিচয়ে ‘মুই কি হনু রে’ ভাবধারা তৈরির সাংবাদিকতা। এভাবেই ‘আউচ সংবাদ’ তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে ‘সরকার নিউজ এজেন্সি’।

আর সেভাবে ধরলে জাতীয় পর্যায়ে অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম তো নামে-বেনামে সরকার নিউজ এজেন্সিই। এটা এক ধরনের ক্ষমতা-কাঠামো। এই ক্ষমতা সরকারি, বেসরকারি, সমাজ, ব্যক্তি–যেকোনো কিছু হতে পারে। তবে পুঁজির দুনিয়ায় অর্থ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। ফলে সংবাদমাধ্যমের একাংশ বিনা প্রশ্নে ও সন্দেহাতীতভাবে সবকিছু প্রচারে নেমেছে। সংবাদমাধ্যম কেবলই প্রচারযন্ত্র–এমনটাই আমরা বানিয়ে ফেলেছি।
তাই আমরা নিরপেক্ষ ও জ্ঞানদীপ্ত সত্তার অভাবে ভুগছি। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, এ দেশের সংবাদমাধ্যম ‘আউচ’ সাংবাদিকতাই করে যেতে চায় কিনা? তাহলে কি ‘সরকার নিউজ এজেন্সি’ হব সবাই! আর মাঝে মাঝে কেমব্রিজ ডিকশনারিতে আটকে গিয়ে একটু ‘আউচ’ শব্দ করব, যা মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। কথায় তো আছেই, ‘নাই দেশে বিচি কলাই সন্দেশ’!
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]