৬-৭ মে রাতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরের (পিওকে) নিকটবর্তী এবং পাকিস্তানের গভীরে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তুতে যে জোরালো হামলা চালানো হয়েছিল, তা ভারত-পাকিস্তানের শক্তির খেলার যে বৃহত্তর কাঠামো–তার ভেতরকার দুটি বিদ্যমান উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হওয়া উচিত ছিল।
প্রথমত, কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন পর্যটককে বর্বর আচরণ ও (ধর্ম)বিশ্বাসের ভিত্তিতে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে যুক্তিসঙ্গত ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা প্রশমিত করার জন্য এটি ছিল ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার একটি বিলম্বিত পদক্ষেপ। এটি আরও আগে ঘটতে পারত। কিন্তু ফরাসি প্রবাদ অনুসারে, ‘প্রতিশোধ হলো এমন একটি খাবার, যার সর্বোত্তম পন্থা হলো ঠান্ডা করে পরিবেশন করা’। কারণ, দ্রুততার চেয়ে প্রতিক্রিয়ার নিশ্চয়তা ও অনিবার্যতা জরুরি। কারণ, এর মাধ্যমে আক্রমণকারীর কাছে একটি উপযুক্ত বার্তা যায়য় এবং এটি ভুক্তভোগীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়।
এখানে এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক ‘যুদ্ধের ঘটনা’ বর্ণনার জন্য ‘সীমান্তের বাইরে সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটি বারবার আমাদের তাড়া করছে। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা এবং তারপর স্বীকৃত সীমানা পেরিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য প্রেরণা দেওয়া সব সময়ই যুদ্ধের ঘটনা বলে বিবেচিত ছিল। এবং এর উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়ার দাবিও ছিল। অপরাধীদের নন-স্টেট অ্যাক্টর হিসেবে বর্ণনা করে এটি আরও জটিল করা হয়েছিল, যা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অপপ্রচারমূলক পদক্ষেপ ছিল। তাদের দাবি ছিল, এরা কাশ্মীরি ‘স্বাধীনতাকামী’। আসুন আমরা আরও স্মরণ করি, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন। এবং জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের অধীনে আমেরিকাকে আত্মরক্ষার জন্য কাজ করার অধিকার দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের কাছে ‘প্রতিশোধ’-এর যেকোনো পদক্ষেপ যতই দর্শনীয় বা সন্তোষজনক বলে মনে হোক না কেন, তাকে আসলে একটি কৌশলগত-স্তরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। ভারতের জন্য যা প্রয়োজন, তা হলো একটি সুচিন্তিত কৌশল এবং এরই অংশ আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘প্রচলিত প্রতিরোধ’ প্রতিষ্ঠা (অথবা পুনঃপ্রতিষ্ঠা) করা। উপমহাদেশে পারস্পরিক পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধ ২৬ বছর ধরে টিকে আছে (ভারতের “প্রথমে ব্যবহার না করার” প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও), কারণ কোনো পক্ষই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করেনি। কিন্তু পাকিস্তানের ওপর ভারতের উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যগত শ্রেষ্ঠত্ব তখন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, যখন– (ক) চীন-পাকিস্তান অক্ষের উত্থানের সাথে সাথে একটি ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ বাস্তবে পরিণত হয় এবং (খ) পাকিস্তান কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করে এবং ভারতের কথিত ‘কোল্ড স্টার্ট’ মতবাদ ‘নমনীয় প্রতিক্রিয়া’ মতবাদে রূপান্তরিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে, ২০১৬ সালে উরি-পরবর্তী ভারতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামা-পরবর্তী বিমান হামলার পর এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও আমরা পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সীমা কমানোর দাবিকে ধোঁকা দিয়েছিলাম। তবুও প্রচলিত ক্ষেত্রে আমরা তা রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
ফলস্বরূপ, পাকিস্তান কাঠুয়া থেকে কুপওয়ারা এবং এর মাঝামাঝি নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে জঙ্গিদের সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছদ্মবেশে পীর পাঞ্জাল এবং কারাকোরাম রেঞ্জের চ্যালেঞ্জিং জঙ্গল ও পাহাড়ি অঞ্চলে তারা অনুপ্রবেশ করে। সশস্ত্র পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের ছোট ও দ্রুত অবস্থান পরিবর্তনকারী দলগুলো খুব কম কাজ করে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকতে সক্ষম। হিট-অ্যান্ড-রান কৌশল ব্যবহার করে এই জঙ্গিরা বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সেনাকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এই তথাকথিত ‘অসম যুদ্ধ’-এর স্তরে প্রচলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায় হলো–যারা এর পরিকল্পনা, সমর্থন ও পরিচালনা করে–সেই পাকিস্তানি ‘ডিপ স্টেট’কে যন্ত্রণা ও শাস্তি দেওয়া। এটি (এই ডিপ স্টেট হলো) সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর এবং সামরিক গোয়েন্দা শাখা আইএসআই-এর দুষ্ট জোট, যা পাকিস্তানের কথিত রাজনৈতিক নির্বাহীদের তত্ত্বাবধান এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ইমরান খানকে কারাবন্দী করার পর সামরিক বাহিনী/ডিপ স্টেট পাকিস্তানের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করে। সম্প্রতি পাকিস্তানের জনগণ শাসনব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার বিরুদ্ধে তাদের গভীর বিরক্তির ক্রমবর্ধমান প্রমাণ দিয়েছে। এই জোট দ্রুত অবনতিশীল অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহগুলোকে ভুলভাবে পরিচালনা করছে।'
সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের দেওয়া এক উত্তেজক ও অসৈনিকসুলভ প্রকাশ্য বক্তব্য সেনাবাহিনীর এই আশার প্রমাণ বলে মনে হচ্ছে যে, ভারতের সাথে সংঘর্ষে তার হারানো উজ্জ্বলতা কিছুটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। এই পটভূমিতে পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে ভারতের প্রতিক্রিয়া যথাযথ ও সময়োপযোগী ছিল। জেনারেল মুনির যখন অনুপযুক্তভাবে কাশ্মীরকে ‘পাকিস্তানের ঘাড়ের শিরা’ হিসেবে উল্লেখ করেন, তখন তিনি স্পষ্টতই ভুলে গিয়েছিলেন যে, এর আসল ঘাড়ের শিরা হলো উচ্চ অববাহিকায় ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পাঁচটি নদী।
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচলিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, যদি ভারতীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনাকারীরা দুটি বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকেন। প্রথমত, দ্রুত হামলার প্রাথমিক ধারা আরও অনুসরণ করার প্রয়োজন হতে পারে। জনগণের হতাশা, প্রাণহানি ও আরও উত্তেজিত হওয়ার স্পষ্ট আশঙ্কার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। একই সাথে, জনমত ‘দাঁতের বিনিময়ে চোয়াল’ দাবি করতে পারে। তবে আমাদের সামরিক নেতৃত্বের ‘উত্তেজনা’র সিঁড়ি সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত, যেখানে পা রাখা সহজ কিন্তু লাফিয়ে পড়া কঠিন। উপমহাদেশের ওপর পারমাণবিক যুদ্ধের ছায়া ঝুলে আছে। তাই ভারতীয় পরিকল্পনাকারীরা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে কেবল যুদ্ধবিমান থেকে চালিত অস্ত্র ব্যবহার করে এবং পাকিস্তানি সামরিক ইউনিট এড়িয়ে শুধু সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে স্পষ্ট সংকেত পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। উপরন্তু, আন্তর্জাতিকভাবে এবং সীমান্তের ওপারে বোঝাতে হবে যে, আমাদের লক্ষ্য সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলা এবং সীমান্তের বাইরে সশস্ত্র কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের জোরালো প্রতিশ্রুতি আদায় করা।
তবে বেশ কয়েকটি কারণে এই ধরনের হুমকি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা প্রয়োজন। উপমহাদেশে যেকোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনায় আঞ্চলিক, এমনকি বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। অতএব পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রগুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণের অধীনে থাকতে হবে এবং বৃহৎ শক্তিগুলো পাকিস্তানের যেকোনো পারমাণবিক অভিযান প্রতিরোধে যেন দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারে। আমাদের এটাও বিশ্বাস করা উচিত যে, অতীতের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তাদের শয়তানি সত্ত্বেও পাকিস্তানি জেনারেলরা এ কথা বোঝার মতো যথেষ্ট বুদ্ধিমান যে, ভারতের পাল্টা পারমাণবিক হামলায় তাদেরও পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
শেষ কথা: আইএসআই-এর প্রতিটি ডিজির স্বপ্ন হলো–ভারতের জাতিগত-ধর্মীয় বিভেদকে কাজে লাগানো, যাতে এটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হয়। আমাদের তা হতে দেওয়া উচিত নয়।
লেখক: ভারতীয় নৌবাহিনী সাবেক প্রধান
(লেখাটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সৌজন্যে এবং ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষিপ্তাকারে অনুদিত।)
[এই মতামত লেখকের নিজস্ব। এর সঙ্গে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পাদকীয় নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই।]