এই সপ্তাহে হেগ শীর্ষ সম্মেলনে মার্ক রুটের একটা বিরাট কাজ ছিল। সেটা হলো, বর্তমান নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের ভিন্ন ভিন্ন মতামতকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। সম্মেলনে ন্যাটো জোটের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল নিশ্চিত করতে রুটের প্রয়াস ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি অত্যন্ত বিনীত, প্রকাশ্য চাটুকারিতার মাধ্যমে আপাতত তিনি সফল হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।
কিন্তু এই বৈঠক এবং এর প্রস্তুতি যা ক্রমশ স্পষ্ট করে তুলেছে তা হলো, আমেরিকা ও ইউরোপ আর নিজেদের জন্য কাউকে একক অভিন্ন শত্রু হিসেবে দেখে না। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃত হুমকির বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক জোট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই জোট সংজ্ঞায়িত হয়েছিল, যা ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি পর্যন্ত টিকে ছিল। ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ এবং ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করার পর থেকে, ন্যাটো মস্কোকে আন্তর্জাতিক শান্তির প্রধান হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান যুদ্ধবাজ চীন আমেরিকার কাছ থেকে আরও মনোযোগ দাবি করছে।
কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ রয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে প্রতিটি ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে: আমরা আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের সনদের উদ্দেশ্য ও নীতি মেনে চলি এবং নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত ২৫ জুন হেগ শীর্ষ সম্মেলনে প্রকাশিত ঘোষণাপত্রে এর কোনো উল্লেখ নেই। প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক ঘোষণাগুলো থেকে সরে এসে, হেগ শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের পাঁচটি অনুচ্ছেদ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সম্পূর্ণভাবে সামরিক সক্ষমতা ও তা বজায় রাখার জন্য অর্থনৈতিক বিনিয়োগের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। এবারের ঘোষণায় আন্তর্জাতিক আইন-শৃঙ্খলার কোনো উল্লেখ নেই।
এটি সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে ছোট করা এবং একটি শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফলকে সতর্কতার সাথে সাজানো। যা আদপে ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত হস্তক্ষেপকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটি আমেরিকান কৌশলগত গতিপথ এবং কানাডা ও ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যদের দ্বারা অনুভূত নিরাপত্তা স্বার্থের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান বিভাজনের লক্ষণও বলে মনে হচ্ছে।
এই ঘোষণা এত সংক্ষিপ্ত এবং এত সংকীর্ণ বিষয়ের ওপর এতটা নিবদ্ধ ছিল যে, এটি অস্বাভাবিকভাবে গভীর পার্থক্য নির্দেশ করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে, ন্যাটো মিত্ররা রাশিয়ার সমালোচনা এবং ইউক্রেনের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ ছিল; এখন পর্যন্ত আছে।
জানুয়ারি মাস থেকে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে কোনো সামরিক সহায়তা অনুমোদন করেনি। পাশাপাশি ইউক্রেনকে সহায়তা ও রাশিয়ার সমালোচনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। ট্রাম্প কার্যকরভাবে রাশিয়ান আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করার শর্তে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছেন। তার প্রস্তাবে ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ এবং কিছু অন্যান্য দখলকৃত অঞ্চলের ওপর কার্যত নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তিনি আরও প্রস্তাব করেছেন, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না। তবে নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং ইইউতে যোগদানের অধিকার পেতে পারে।
এদিকে, ইউরোপীয় মিত্ররা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় অর্থায়ন ও সমর্থন বাড়াতে, সহায়তা ও সামরিক সমর্থন বৃদ্ধি করতে এবং নিষেধাজ্ঞা বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে। ইউরোপ ও কানাডা বনাম আমেরিকার ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকারের আরেকটি লক্ষণ ছিল ইউক্রেনের ডিফেন্স কনট্যাক্ট গ্রুপের নেতৃত্ব থেকে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথের সরে আসার সিদ্ধান্ত। এটি বিশ্বজুড়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদানকারী রাষ্ট্রগুলোর একটি অ্যাড-হক জোট। হেগসেথ প্রতীকীভাবে জুন মাসে গোষ্ঠীটির প্রাক-শীর্ষ সম্মেলন বৈঠকেও অংশ নেননি।
ট্রাম্প দীর্ঘকাল ধরে জোর দিয়ে আসছেন যে, ন্যাটো সদস্যদের তাদের জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার ২০১৪ সালের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা উচিত এবং রুট তা স্বীকার করেছেন। ২০১৮ সালে, ট্রাম্প এটিকে বাড়িয়ে ৪ বা ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু এটিকে অযৌক্তিক বলে খারিজ করা হয়েছিল। এখন রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে এবং মার্কিন সমর্থন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে ন্যাটো সদস্যরা (স্পেন বাদে) আগামী ১০ বছরে জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী, রাষ্ট্রগুলোকে আক্রমণের প্রতিরোধে সক্ষমতা বজায় রাখতে ও বিকাশিত করতে হবে। তবে ২০২২ সাল থেকে, এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে অনেক ন্যাটো সদস্য কোনো বড় সামরিক অভিযানের জন্য অপ্রস্তুত। একই সময়ে, তারা ক্রমশ অনুভব করছে যে রাশিয়া তাদের দোরগোড়ায় আরও বেশি হুমকি। বিশেষ করে বাল্টিক রাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের এই চিন্তা রয়েছে যে তাদের সামরিক ব্যয় ও প্রস্তুতি বাড়াতে হবে।
আমেরিকা চীনের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়ার জন্য মার্কিন নৌবাহিনীর একটি বড় অংশ প্রশান্ত মহাসাগরে স্থানান্তরিত করবে। তারা তাদের সবচেয়ে সক্ষম নতুন জাহাজ ও বিমানগুলোও ওই এলাকার জন্য বরাদ্দ করবে। পাশাপাশি সাধারণ অভিযান, প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নমূলক মহড়া ছাড়াও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে মিত্র ও অন্যান্য নৌবাহিনীর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। এজন্য মার্কিন বাহিনীকে ইউরোপের জন্য নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি কমাতে হবে। ইউরোপীয় মিত্রদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বজায় রাখার জন্য সেই সক্ষমতাগুলি অর্জন করতে হবে।
ন্যাটো চুক্তির ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাধারণত ‘একজনের ওপর আক্রমণ সবার ওপর আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। হেগ শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার পথে, ন্যাটোতে মার্কিন প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে অনিশ্চিত মনে হয়েছিল ট্রাম্পকে। শীর্ষ সম্মেলনে এটি স্পষ্ট করতে বলা হলে, ট্রাম্প বলেছিলেন: “আমি এর [অনুচ্ছেদ ৫] সাথে আছি। তাই আমি এখানে আছি। যদি আমি এর সাথে না থাকতাম, তাহলে আমি এখানে থাকতাম না।”
ন্যাটোর প্রথম মহাসচিব লর্ড ইসমায় পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, এই জোটের উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ানদের বাইরে রাখা, আমেরিকানদের ভেতরে রাখা এবং জার্মানদের নিচে রাখা। জার্মানি এখন ন্যাটোর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আমেরিকানরা আছে, যদিও বিক্ষিপ্ত। তবে ফাটল রয়েছে। রুট যদি রাশিয়ানদের দূরে রাখতে চান, তবে ইউরোপকে রক্ষা করার বিষয়ে ট্রাম্পের কমতে থাকা আগ্রহ বদলাতে হবে।
অ্যান্ড্রু করবেট: ডিফেন্স স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার, কিংস কলেজ, লন্ডন
(দ্য কনভারশেসনে প্রকাশিত এবং ইংরেজি থেকে অনূদিত)