টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর বোলার কে? পেসারদের তালিকা করলে গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেমস অ্যান্ডারসন, ম্যালকম মার্শাল, ওয়াসিম আকরাম, কাপিল দেব আর হালের জাসপ্রিত বুমরার নাম থাকবে তালিকার ওপরের দিকে। স্পিনারদের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন মুত্তিয়া মুরালিধরন ও শেন ওয়ার্ন।
আর পেসার-স্পিনার দুটো একসঙ্গে বিবেচনায় নিলে? সবচেয়ে ভয়ংকর হিসেবে অধিকাংশের ভোট পড়তে পারে বুমরার বাক্সে। ভারতীয় পেসার বল হাতে যা করছেন, তাঁর বাক্সে ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করতে এর চেয়ে বেশি কিছু করার বোধ হয় দরকার নেই!
ব্যতিক্রমী বোলিং স্টাইল, দুর্দান্ত গতি, সুইংয়ের সঙ্গে ইয়র্কার দেওয়ার ক্ষমতা বুমরাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে। ক্রিকেটের যে কোনো সংস্করণ কিংবা ম্যাচের যেকোনো পরিস্থিতি হোক না কেন, বল পুরোনো নাকি নতুন- সেসবে কিচ্ছু যায় আসে না। বল হাতে বুমরা সবসময়ই সমান ভয়ংকর। সেটা নতুন করে আরেকবার জানান দিয়েছেন লিডসের হেডিংলিতে চলমান ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজের প্রথম টেস্টে।
প্রথম ইনিংসে ভারত ৪৭১ রান করার পর ইংল্যান্ড আটকে গেছে ৪৬৫ রানে। ৬ রানের লিডে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে ৮২ রানে ২ উইকেট হারিয়ে গতকাল টেস্টের তৃতীয় দিন শেষ করেছে ভারত।
হেডিংলিতে বল হাতে বলতে গেলে একাই আটকে দিয়েছেন ইংলিশদের। ৮৩ রানে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। ডানহাতি এ পেসারের বলে সতীর্থরা ক্যাচও ফেলেছেন চারবার। এছাড়া হ্যারি ব্রুক বুমরার বলে সিরাজের হাতে ক্যাচ দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় পেসারের ওই বলটা ‘নো’ বল ছিল।
পুরো ইনিংসে ব্রুকস-ডাকেটদের বেশ কয়েকটি ক্যাচ ভারতের ফিল্ডাররা না ছাড়লে কী হতো, সেটা এখন বলা মুশকিল। তবে তিনবার জীবন পেয়ে ব্রুকস শেষ পর্যন্ত করেছেন ৯৯ রান, ডাকেট দুবার জীবন পেয়ে করেছেন ৬২। এর বাইরে ইংল্যান্ড যে শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রথম ইনিংসের স্কোরের একটা ছক্কার দূরত্বে যেতে পেরেছে, তার পেছনে বড় অবদান তিনে নামা ওলি পোপের ১০৬ রান, সেই ওলি পোপেরও একটা ক্যাচ হাতছাড়া হয়েছে বুমরার বলে।
তবে জীবন পেয়েই হোক, ব্রুকস-ডাকেট-পোপদের ব্যাটে ইংল্যান্ড যখন উল্টো লিড নেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল, তাদের থামিয়েছেন সেই বুমরাই। ইংল্যান্ডের সাফল্য এতটুকুই যে, তারা বুমরাকে চতুর্থ-পঞ্চম স্পেলে বোলিং করতে বাধ্য করতে পেরেছে।
যে ৫ উইকেট পেয়েছেন বুমরা, এর তিনটিই বোল্ড। বাকি দুটি স্লিপে ক্যাচ। সহজেই অনুমান করা যায়, ব্যাটসম্যানদের কতটা কাহিল করেছেন বুমরা। ভারতীয় পেসারের এমন ভয়ংকর পারফরম্যান্সে প্রশ্নটা আবারও নতুন করে উঠেছে। বুমরাই কি টেস্ট ইতিহাসে সেরা?
সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বুমরাকে নিয়ে একটা কলাম লিখেছেন সাবেক ইংলিশ পেসার স্টিভেন ফিন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে সে কলামের শিরোনাম, ‘বুমরা যে কারণে সর্বকালের সবচেয়ে পরিপূর্ণ পেসার।’
ইনডিপেনডেন্ট টিভির পাঠকদের জন্য কলামটি বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো:
ভারতের জাসপ্রিত বুমরাই ইতিহাসে সবচেয়ে পরিপূর্ণ পেসার- এ দাবি খারিজ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
প্রতিবার বল হাতে নিয়ে ও যেভাবে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়, সেটা অসাধারণ। হেডিংলিতে প্রথম টেস্টে ও যা করেছে, সে তার চেয়েও অনন্য। প্রথম ইনিংসে ৮৩ রানে ৫ উইকেট নিয়েছে বুমরা। এছাড়া ওর বলে ৩টি ক্যাচ পড়েছে এবং হ্যারি ব্রুককে একবার আউট করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল নো বল।
বুমরা যখনই বল করে, পুরো দৃশ্যটা ‘বক্স অফিসের’ মতো লাগে। প্রতি ডেলিভারিতেই কিছু না কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ওকে দেখে মনে হয়, যেন অন্য বোলাররা ভিন্ন কোনো খেলায় অংশ নিয়েছে!
সে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানকেও মুহূর্তেই বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে। ও হাত ঘোরাচ্ছে, শেষ মুহূর্তে কবজির একটা ফ্লিক…কিছু বুঝে ওঠার আগেই আপনি দেখছেন বল আপনার সামনে!
যদি কখনো দুর্ভাগ্যক্রমে আমি বুমরার মুখোমুখি হতাম, আমাকে ফেরাতে ওর সর্বোচ্চ দুটি ডেলিভারি লাগত। প্রথমে একটা শর্ট বল, এরপর একটা বিধ্বংসী ইয়র্কার- এতেই কাজ শেষ। সে হয়তো শুরুতে ইয়র্কার করবে। বুমরার বোলিংয়ের সময় বল দেখা একপ্রকার অসম্ভব। একজন টেলএন্ডার হিসেবে আমাকে সহজেই বিপদে ফেলত বুমরা।
অদ্ভুত বা ব্যতিক্রমী অ্যাকশনের বোলারদের সহজে বোঝা যায় না। ব্যাটসম্যানদের কাছে এমন কথা প্রায়ই শুনে থাকবেন। আর যেসব বোলার বোলিংয়ের সময় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বল ব্যাটসম্যানের আড়ালে রাখেন- তাদের মোকাবেলা করা সত্যিই দুঃস্বপ্নের মতো।
জাসপ্রিত বুমরা ঠিক তেমনই একজন বোলার। ওর বল ছোঁড়ার স্টাইলটা একেবারে আলাদা। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে বুমরার বোলিং অ্যাকশনটা কল্পনা করুন। ওর পুরোপুরি সোজা হাতটি ঘড়ির কাঁটায় ২টার দিকে থাকে। হাতটা দ্রুতই নেমে এসে বোলিং আর্কে যায়। ঠিক বল ডেলিভারির সময় ওর কনুইটা একটু বেশি বেঁকে যায়। এটা থেকে সে বাড়তি গতি পায়। পাশাপাশি বলটা কনুইয়ের পেছনে চলে যায়। এতে মুহূর্তের জন্য বলটি ব্যাটসম্যানের চোখের আড়াল হয়।
বুমরার ফোরআর্ম বাকি হাতের সঙ্গে লেগে থাকে। এতে করে কব্জির মোচড়ে যে যেকোনো ডেলিভারি ছুঁড়তে পারে। পুরো ব্যাপারটা গুলতি ছোঁড়ার মতো। ব্যাটসম্যানের চোখের আড়ালে যাওয়া বলটা একদম শেষ মিলিসেকেন্ডে ব্যাটসম্যানের চোখের সামনে আসে, এরপর ঘণ্টায় প্রায় ৯০ মাইল গতিতে সামনে পড়ে।
বুমরা আরেকটি বড় সুবিধা পান বল রিলিজ পয়েন্ট থেকে। অন্য যেকোনো পেসারের তুলনায় ব্যাটসম্যানের খুব কাছ থেকে বল ছোড়েন বুমরা। এটা ব্যাটসম্যানদের কাজটা আরও কঠিন করে তোলে।
ধরুন কোনো পেসারকে পাশ থেকে দেখছেন। সাধারণত বোলাররা বল ছোঁড়ে তাদের সামনের পায়ের ঠিক ওপর থেকে। বুমরা বল ছোঁড়ার সময়ে ওর হাত সামনের পা থেকেও প্রায় ৪০ সেন্টিমিটার সামনে নিয়ে যায়। এতে ব্যাটসম্যান সময়টা তুলনামূলক কম পান।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বুমরার রানআপ দেখে বোঝার উপায় নেই, ও এত জোরে বল করতে পারে। অল্প রানআপে খানিকটা থেমে থেমে যায়। দেখে মনেই হয় না, ও এত বিধ্বংসী বোলিং করতে পারে।
ব্যাটসম্যানরা যত ইচ্ছে বুমরার বোলিংয়ের ভিডিও বিশ্লেষণ করুক না কেন, মুখোমুখি হলে তারাও ভড়কে যায়। ওর হাতের গতিপথের কোনো পরিবর্তন নেই, আঙুলের অবস্থানও একই থাকে। ও কী বল করবে, সেটা আগে থেকে বলা যায় না। ব্যাটসম্যানের সামনে একটাই রাস্তা খোলা থাকে। বল যেমন আসে, সেটা দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানো।
ব্যতিক্রমী অ্যাকশনের বোলারদের আরেকটা বিশেষণ দেওয়া হয় – বিয়ন্ড দ্য পারপেনডিকুলার। ঘড়ির কাঁটা দিয়েই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা যাক।
কোনো বোলার যখন পুরোপুরি সোজাভাবে (ওভার দ্য টপ) বল করেন, পেছনে থেকে দেখলে মনে হবে, হাত থাকে ১২টার দিকে। অর্থাৎ সোজা মাথার ওপর। আর যারা রাউন্ড আর্ম অ্যাকশনে বোলিং করেন, তাদের হাত থাকবে একটা বা দুইটার দিকে।
কিন্তু পারপেনডিকুলারের বাইরে যাওয়া বোলাররা ১১টার দিকে হাত এনে বোলিং করেন। এতে এমন একটা কোণ তৈরি হয়, যাতে ডানহাতি ব্যাটসম্যান সবসময় মনে করেন, বলটা ভেতরের দিকে ঢুকছে। এতে এমন অনেক অপ্রয়োজনীয় ডেলিভারিও খেলতে বাধ্য হন তারা।
এই অ্যাঙ্গেলের সবচেয়ে নিখুঁত ব্যবহার করে বুমরাই। ইংল্যান্ডের জো রুটের বিপক্ষে ওর সাফল্যই সেটার প্রমাণ দেয়। টেস্টে রুটকে ১০বার আউট করেছে বুমরা। রুটকে এর চেয়ে বেশিবার আউট করতে পেরেছেন শুধু প্যাট কামিন্স আর জশ হ্যাজলউড।
এই টেস্টের প্রথম ইনিংসেও সেটাই দেখা গেছে। বুমরা অফ স্টাম্পের বাইরে বল ফেলল। ভেতরে ঢুকবে মনে করে রুট খেলতে বাধ্য হলো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বল বাঁক নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। একই চিত্র ২০২১ সালের সিরিজেও দেখা গেছে।
শুধু অ্যাকশনের টেকনিক্যাল দিকগুলো নয়, আমার মনে হয় না ইতিহাসে আর কোনো ফাস্ট বোলার আছেন, যিনি ধারাবাহিকভাবে প্রতি ম্যাচে এভাবে প্রভাব ফেলেছেন। ও একটা কম্পিউটারের মতো। যে পরিস্থিতিতে যা করতে হবে, নিখুঁতভাবে ঠিক সে কাজটাই করতে পারে।
ওর বহুমাত্রিকতার দিকে তাকান। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেরা দলগুলোর বোলারদের মধ্যে যারা অন্তত ৫০০ বল করেছেন, তাদের মধ্যে সেরা ইকোনমি রেট (৬.২৭) বুমরার। একইসঙ্গে টেস্ট ইতিহাসে ২০০ উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং গড়ও (১৯.৩৩) ওরই। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি ম্যালকম মার্শালের গড় ২০.৯৪।
আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বুমরার চেয়ে কম গড়ে ১০০ এর বেশি উইকেট পাওয়া বোলারদের সবাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে খেলেছেন।
যে সময়টাতে এসে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি সংস্করণের বোলারদের দক্ষতার ব্যবধান ক্রমশ বেড়েই চলছে, সংস্করণ ভেদে বোলারদের ভিন্ন ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে, সেখানেও বুমরা দুই সংস্করণেই সেরাদের সেরা।
বুমরা এ খেলাটা নিয়ে খুব ভাবে। ভারতের নতুন টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বুমরাই হতে পারত প্রথম পছন্দ। কিন্তু প্রতিটি ম্যাচ সে খেলতে পারবে না। তার অনুপস্থিতি দলের ওপর প্রভাব ফেলবে। সে কারণে নিজেই অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ ছেড়ে দিয়েছে।
আমরা ভাগ্যবান যে, দুর্দান্ত সব পেসারদের যুগে আছি। সম্প্রতি অবসর নেওয়া স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসন থেকে শুরু করে কাগিসো রাবাদা, কামিন্স, হ্যাজলউড ও মিচেল স্টার্ক। এ খেলাটায় খেলা সেরা সব পেসারদের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন বুমরাই। কিছু প্রশংসা ওর প্রাপ্য।