আহমেদাবাদে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পর ভারতে আকাশপথে যাত্রায় অনেক বাধা আসছে। বিভিন্ন কারণে গত ৩৬ ঘণ্টায় ভারতগামী তিনটি ফ্লাইট ভারতে অবতরণ করতে পারেনি। এসব ফ্লাইট ফিরে গেছে জার্মানি, হংকং ও যুক্তরাজ্যে। উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি ও বোমা হামলার হুমকির জেরে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে এসব ফ্লাইটের কর্তৃপক্ষ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, এই তিনটি ফ্লাইটের ক্ষেত্রেই উড়োজাহাজ ছিল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। এগুলো ভারতের চেন্নাই, হায়দরাবাদ ও দিল্লিতে অবতরণ করার কথা ছিল। এর মধ্যে আজ সোমবার হংকং থেকে দিল্লিগামী এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার পরিচালিত ফ্লাইটে মাঝ আকাশেই হঠাৎই যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। ফ্লাইট এআই ৩১৫ হংকং থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। তবে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে তড়িঘড়ি করে আবার ফিরে যায় হংকংয়েই।
এবার পাইলট আর কোনো ঝুঁকি নেননি। মাঝ আকাশে বিপদের গন্ধ টের পেয়েই তিনি ফ্লাইটটি ফের হংকংয়ে ফেরত নিয়ে যান। ওড়ার পরপর মধ্য আকাশে যান্ত্রিক গোলযোগের বিষয়টি বুঝতে পারেন পাইলট। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি উড়োজাহাজটির যাত্রাপথ ঘুরিয়ে ফের হংকংয়ে অবতরণ করান।
এর আগে রোববার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট ভারতের চেন্নাইয়ে আসার কথা। এটিও ছিল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার। লন্ডনের হিথ্রো থেকে ভারতে আসার পথেই ধরা পড়ে যান্ত্রিক ত্রুটি। দ্রুত ঘুরে ফিরে যায় লন্ডনে, নিরাপদে অবতরণ করে হিথ্রোতে। এ নিয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ একটি বিবৃতিও দিয়েছে। আগের ফ্লাইটের মতো এটিও দেরিতে ছেড়েছিল।
এ ছাড়া ভারতের হায়দারাবাদগামী লুফথানসার একটি বিমান মাঝ আকাশ থেকে ঘুরে ফিরে গেছে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে। হায়দরাবাদ বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তার বরাতে এএনআই জানিয়েছে, বিমানটিতে বোমা থাকার হুমকি পাওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কর্মকর্তা বলেন, ফ্লাইটটি তখনও ভারতের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি। সেই সময়েই বোমাতঙ্কের খবর পাওয়া যায়। ফলে এটি আবার ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে যায়।
এর আগে লুফথানসার এক মুখপাত্র জানান, হায়দারাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি না পাওয়ায় বিমানটি ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ফ্লাইটটি সোমবার ভোরে হায়দারাবাদে পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে মাঝ আকাশে থাকা অবস্থায় হঠাৎ দিক পরিবর্তন করে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরে যায়। উড়োজাহাজটি ছিল বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার মডেলের।
উল্লেখ্য, বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার সম্প্রতি ভারতে বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছে। কারণ গত সপ্তাহে আহমেদাবাদে একটি ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় এই মডেলের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ওই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ২৪২ জন যাত্রীর মধ্যে ২৪১ জনই নিহত হন। মোট ২৭৪ জন প্রাণ হারান। বিমানটি লন্ডনের গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে যাচ্ছিল।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান বলছে, যদিও সম্প্রতি বোয়িংয়ের তৈরি ৭৮৭ উড়োজাহাজগুলোর ইঞ্জিনের নানা সমস্যার কারণে অনেক এয়ারলাইনসই এই মডেলটি দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ রেখেছে অথবা ফ্লাইট সংখ্যা কমিয়েছে, কিন্তু তারপরেও এগুলোর নিরাপত্তা পরিসংখ্যান বেশ ভালো।
গত বছর লাতাম এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ মধ্য আকাশে থাকার সময় কিছু সমস্যা তৈরি হওয়ার পর ড্রিমলাইনারের নিরাপত্তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ)।
ওয়াশিংটনে এ সংক্রান্ত এক শুনানিতে একজন হুইসেল ব্লোয়ার বিশ্বব্যাপী বোয়িংয়ের ৭৮৭ মডেলের সবগুলো উড়োজাহাজকে গ্রাউন্ডেড করার পরামর্শ দেন। সে সময় বোয়িং সাবেক এই প্রকৌশলীর বক্তব্য খারিজ করে জানায়, উড়োজাহাজগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের প্রধান প্রধান এয়ারলাইনসগুলো তাদের বহরে ড্রিমলাইনার রেখেছে। এ সংখ্যা ১ হাজার ১০০টিরও বেশি। মডেলটি অন্যান্য উড়োজাহাজের থেকে অনেক বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং এতে শব্দও কম।
এর আগে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের দুটি উড়োজাহাজ ইন্দোনেশিয়া এবং ইথিওপিয়ায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বোয়িং। দুই দুর্ঘটনায় মোট ৩৪৬ জনের প্রাণহানি হয়। এরপর এই মডেলের উড়োজাহাজগুলো প্রায় ১ বছরের জন্য বসিয়ে রাখতে হয় বোয়িংকে। পরে নতুন করে আবারও পাখা মেলার অনুমতি পায় ৭৩৭ ম্যাক্স।
ভারতীয় অ্যাভিয়েশনের নিরাপত্তা ইতিহাস বেশ বর্ণিল। কিন্তু এয়ারলাইনস শিল্পের বিকাশ এবং যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশটির আকাশপথের নিরাপত্তায় বেশ উন্নতি হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এয়ার ইন্ডিয়া ড্রিমলাইনার ব্যবহার করছে। বর্তমানে এর বহরে আছে এই মডেলের ৩০টি উড়োজাহাজ। সম্প্রতি যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলো এটি এয়ার ইন্ডিয়ার বহরে যুক্ত হয় ২০১৪ সালে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাধারণত উড়োজাহাজের দুর্ঘটনাগুলো ওঠা ও নামার সময়েই বেশি হয়। ফ্লাইটর্যাডারের তথ্য বলছে, দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটি ৬২৫ ফিট পর্যন্ত উঠেছিল। এর আগে ২০২০ সালের আগস্টে এয়ার ইন্ডিয়া সবশেষ দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। সেই বার এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি বোয়িং ৭৩৭–৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে কালিকুট বিমানবন্দরে নামার সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে যায়।