বিদায়ী ২০২৪ সালকে নির্বাচনী বছর বলা চলে। ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমসের (আইএফইএস) তথ্য অনুযায়ী, এই এক বছরে বিশ্বের নানা প্রান্তে ৭০টির বেশি দেশে নির্বাচনের শিডিউল ছিল। ভারত থেকে আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া থেকে রাশিয়া, বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দেশে দেশে। টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, যেসব দেশে ২০২৪ সালে নির্বাচন, সেসব দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশ।
২০২৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত দুটি নির্বাচনের একটি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন। অন্যটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর বাইরে যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইরানের মতো দেশগুলোর নির্বাচন ঘিরে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আগ্রহ ছিল। বছরের শুরুতে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন তো ছিলই। আলোচনার জন্ম দিয়েছে ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের নির্বাচন। এসব নির্বাচনে কিছু দেশে ডানপন্থীদের উত্থান ছিল চোখে পড়ার মতো।
আমেরিকায় ট্রাম্পের অন্যরকম ফেরা
আমেরিকার ভোটে ডেমোক্র্যাটদের হয়ে লড়াইয়ে নেমেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিলেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বাস্থ্যগত কারণে বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে ট্রাম্পের মোকাবিলায় নামেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি হবে; এমনকি কমলা জিততে পারেন ধারণা থাকলেও ৫ নভেম্বরের ভোটে আলোড়ন সৃষ্টি করা জয় পান ট্রাম্প। চার বছর আগে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হলেও এবার ট্রাম্পের অসাধারণ প্রত্যাবর্তন দেখেছে সারা বিশ্ব। এই মেয়াদে সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ জয় পেয়েছেন তিনি। কারণ ২০১৬ সালে ইলেকটোরাল কলেজে জয় পেলেও পপুলার ভোটে হেরেছিলেন ট্রাম্প। ২০২৪ এর নির্বাচনে ইলেকটোরাল-পপুলার উভয় ক্ষেত্রে এগিয়ে থেকেই জয় পেয়েছেন এই রিপাবলিকান প্রার্থী। একবার হেরে গিয়ে ফের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়ে আমেরিকার ১৩২ বছরের রেকর্ড ভাঙেন ট্রাম্প। তাঁর এই ফিরে আসা মার্কিন রাজনীতিতে তো বটেই, বৈশ্বিক রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতে জোটের হাত ধরে ফের মোদি
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে ১৮তম সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলে প্রায় দেড় মাসব্যাপী (৪৪ দিন)। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের লোকসভার মোট ৫৪৩ জন সংসদীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচন করা হয়েছে। সাত ধাপে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয় ৪ জুন। আর এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেও জোট সরকার গঠন করতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে।
দেশটির নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, লোকসভার ৫৪৩টি আসনের ২৪০ আসনে জয় পায় ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। আর ৯৯টি আসনে জয় পায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) জোটের মোট আসনসংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৩টি। অপর দিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) জোটের মোট আসনসংখ্যা হয় ২৩৩টি। এবারের লোকসভা নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বিরোধী জোটের পুনরুত্থানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে মোদির বিজেপিও। তবে সবচেয়ে বেশি আসন (২৪০টি) নিয়ে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দলটি। ফলে এবার সরকার গড়তে সমমনা একাধিক দল নিয়ে এনডিএ জোটের শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে বিজেপিকে। সেই জোটের নেতা হিসেবে ৯ জুন তৃতীয়বারের মতো দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদি।
যুক্তরাজ্যে হঠাৎ নির্বাচন এবং লেবার পার্টির বিরাট জয়
ব্রিটেনে প্রায় পাঁচ বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় কনজারভেটিভ পার্টির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ২৩ মে হঠাৎ সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ফলে ৪ জুলাই যুক্তরাজ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সুনাক এমন সময় নির্বাচন ঘোষণা করেন, যখন জনমত জরিপে ২০২২ সালের অক্টোবরের পর থেকে তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থান সবচেয়ে নিম্নে ছিল।
ভোটে লেবার পার্টির জয়ের মধ্য দিয়ে নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হন কিয়ের স্টারমার। ব্রিটেনে সংসদের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০টি। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ৩২৬টি আসনে বিজয়ী হতে হয়। লেবার পার্টি ৪১২টি আসনে জয় পায়। আর কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১টি আসন। এ ছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৭১টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল। এর বাইরে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি নয়টি, আর রিফর্ম ইউকে চারটি আসন নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ্য হয়েছে।
রাশিয়ায় মসনদে বহাল পুতিন
রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল অনুযায়ী দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ১৮ মার্চ এ ফলাফল প্রকাশ করে দেশটির সেন্ট্রাল ইলেকশন কমিশন (সিইসি)। নির্বাচনে পুতিন ৮৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। রেকর্ডসংখ্যক এ ভোট পেয়ে পঞ্চমবারের মতো রুশ প্রেসিডেন্ট হন তিনি।
পাকিস্তানে ইমরানকে ঠেকাতে জোট
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন হয় ৮ ফেব্রুয়ারি। এ নির্বাচনে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ (পিপিপি) কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় গেছে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন পিএমএল-এনের নেতা শাহবাজ শরিফ। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ভোটের লড়াই থেকে দূরে রাখায় পাকিস্তানের এই নির্বাচন আলোচনার কেন্দ্রে ছিল।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন
বছরের শুরুতে ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সব মিলে পঞ্চমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।
গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের ভোটগ্রহণ শেষে নৌকা প্রতীকের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের চিত্র উঠে আসে। পরে দুটি আসনে উপনির্বাচনের ফল মিলিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২২৫টি আসনে জয় পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয় ৬১টি আসনে। ১১টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। আর একটি করে আসন পায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। সরকার গঠন করতে জাতীয় সংসদের ১৫১টি আসন পেতে হয়। নির্বাচনে আসন জয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও দলগতভাবে বিজয়ী আওয়ামী লীগের পরে থাকায় জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে যায়।
আরও কিছু দেশে নির্বাচন
তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৩ জানুয়ারি। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) লাই চিং-তে জয়ী হন। ফিনল্যান্ডে ২৮ জানুয়ারির পার্লামেন্ট নির্বাচনে মধ্য ডানপন্থী ন্যাশনাল কোয়ালিশন পার্টি (এনসিপি) সবচেয়ে বেশি আসনে জয় পায়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় দেশটিতে জোট সরকার ক্ষমতায় বসে। গত ৯ জানুয়ারি ভুটানে পার্লামেন্ট নির্বাচন, ১৪ জানুয়ারি কমরোসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ২৬ জানুয়ারি টুভ্যালুতে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এক দিনে সবচেয়ে বেশি মানুষের ভোট দেওয়ার দিন ছিল গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। এদিন ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। দেশটিতে নিবন্ধিত ভোটার ছিলেন ২০ কোটি ৫০ লাখ। প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর সমর্থিত প্রার্থী প্রাবোও সুবিয়ান্তো জয়ী হন এ নির্বাচনে।
ফেব্রুয়ারিতে আজারবাইজান, এল সালভাদর ও সেনেগালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, কম্বোডিয়ায় সিনেট নির্বাচন এবং বেলারুশে পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়েছে। ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন হয় পর্তুগালে। ১১ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ নির্বাচনের ফলে দেখা যায় উদারপন্থী বিরোধী দলের ভূমিধস বিজয় হয়েছে। জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো বড় সাফল্য পায়। চার দিনের এই নির্বাচন ৯ জুন শেষ হয়। নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২১টি দেশের ৩৫ কোটি ভোটার ভোট দেয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে উজবেকিস্তানে পার্লামেন্ট নির্বাচন, মোজাম্বিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, আফ্রিকার দেশ চাদ ও বতসোয়ানায় প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন, জর্জিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও উরুগুয়েতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়।