পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ৩৬০০ কর্মী চাকরি হারাতে যাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটায়। মার্কিন গণমাধ্যমে বিষয়টি সামনে আসে গত ১৪ জানুয়ারি। বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ৭২ হাজার কর্মীর প্রতিষ্ঠান মেটা এবার ৫ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছে, যেখানে পারফরম্যান্সকেই কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মেটা’র প্রকাশিত আভ্যন্তরীণ এক বার্তায় কর্মী ছাঁটাই প্রসঙ্গে মার্ক জাকারবার্গ বলেন, ‘আমি পারফরম্যান্স ম্যানেজমেন্টের মান বৃদ্ধি এবং যাদের পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়, তাদেরকে দ্রুত সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে ‘সেরা ট্যালেন্ট’ ও ‘নতুন মুখ’ নিয়ে আসার কথাও জানান।
সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ ও প্রযুক্তিবিষয়ক ব্লগ দ্য ভার্জ জানিয়েছে, মেটা’র পরিকল্পনা অনুযায়ী আশানুরূপ পারফর্ম করতে না পারা কর্মীদের দ্রুতই মেটা ছেড়ে যেতে বলা হবে এবং তাঁদের জায়গা নেবে নতুন প্রতিভা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেটায় কর্মী ছাঁটাই করার কারণ কি শুধুই কর্মীদের পারফরম্যান্স, নাকি অন্য কিছু–বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। তবে তার আগে সার্বিকভাবে প্রযুক্তি বিশ্বে কর্মী ছাঁটাই নিয়েও কিছুটা আলোচনা প্রয়োজন।
প্রযুক্তি বিশ্বে কর্মী ছাঁটাই
প্রযুক্তি বিশ্বে কর্মী ছাঁটাই নতুন কিছু নয়। লেঅফস ডট এফওয়াইআই (layoffs.fyi) সাইট জানাচ্ছে, ২০২৪ সালে ৫৪৬টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি হারিয়েছেন ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৪ জন কর্মী। শুধু তাই নয়, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২৩ দিনে ৫২০০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করেছে ১৯টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান।
গত বছর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মী ছাঁটাইয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ‘ব্যয় সংকোচন’। ইউরোপে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে বছরজুড়েই চাপে ছিল বিশ্ব অর্থনীতি। ফলে প্রযুক্তি খাতে ভোগ ও চাহিদা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।
অন্যদিকে গুগল ও মেটার মতো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্তহস্তে বিনিয়োগ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই খাতে। তাতে করে নিত্যনতুন এআই টুল ও ফিচার হয়তো এসেছে, কিন্তু বিনিয়োগ করা অর্থের বিপরীতে যথেষ্ট আয় জেনারেট করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বোর্ড মিটিংগুলোতে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা শেয়ারহোল্ডারদের ভারী নিঃশ্বাস নিয়মিতই উপলব্ধি করেছেন। তাই সঙ্গত কারণেই ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটতে গিয়ে কর্মী ছাঁটাই করেই সামনে এগোতে হয়েছে অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে।
প্রযুক্তি খাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের আরেকটি কারণ ছিল এআই প্রযুক্তি নিজেই। এআইয়ের উৎকর্ষে বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে, ফলে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে।
পারফরম্যান্সই কি একমাত্র কারণ?
জাকারবার্গ চাইছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে লো-পারফরমারদের জায়গা নেবে সেরা প্রতিভাধর নতুন মুখ। তিনি বিষয়টিকে তাঁর প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই দেখছেন, যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কর্মীদের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা হয় এবং যাদের পারফরম্যান্স আশানুরূপ নয়, তাদেরকে প্রস্থানের পথও দেখিয়ে দেওয়া হয়। তবে এবার এই প্রচলিত কার্যক্রমকেই মেটা আরও বিস্তৃত ও ত্বরান্বিত করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাকারবার্গ।
জাকারবার্গের কথাকে আক্ষরিক অর্থে পাঠ করলে অবশ্যই বলতে হয়, কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়টি পারফরম্যান্স মূল্যায়নের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ারই অংশ। তবে বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হওয়ারও বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
৩৬০০ সংখ্যাটি কতটা স্বাভাবিক?
প্রথম কারণটি তো অবশ্যই ছাঁটাই হতে যাওয়া কর্মীদের সংখ্যা। মেটার মতো একটি শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ‘ব্যয় সংকোচন’ ব্যতীত একসাথে এত বিশালসংখ্যক কর্মী ছাঁটাই, সেটাও আবার শুধু পারফরম্যান্সের কারণে–বিষয়টি হজম করা কিছুটা কঠিনই বটে। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে একসাথে ৫ শতাংশ কর্মীর পারফরম্যান্স যদি আশানুরূপ না হয়, অর্থাৎ অসন্তোষজনক না হয়, তাহলে তো প্রতিষ্ঠানের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
এমন নয় যে, মেটা কর্মী ছাঁটাই করে না। কোভিড-১৯ মহামারির পর ২০২২ সালের নভেম্বর মেটা ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। পরের বছর; অর্থাৎ, ২০২৩ সালে আরও ১০ হাজার কর্মীকে বিদায় জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে উভয় ক্ষেত্রেই প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কোভিড আক্রান্ত বিশ্ব যখন লকডাউনের মতো কঠোর বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ, তখন নিজ নিজ আবাসস্থলে আটকে পড়া মানুষেরা অধিক মাত্রায় অনলাইনে সময় কাটাতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় মেটার মালিকানাধীন বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার। যোগাযোগ ও বিনোদনের পাশাপাশি অভূতপূর্ব উত্থান ঘটে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা (এফ-কমার্স) ও পড়াশোনারও (এফ-লার্নিং)।
মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ও তাদের কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বাধ্য হয়েই বিশাল পরিমাণ কর্মী নিয়োগ দেয় মেটা। লকডাউন চলাকালে সবকিছু ঠিকই ছিল। সমস্যা দেখা দেয় কোভিড-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব পুনরায় স্বাভাবিক হতে শুরু করার পর। ‘হোম অফিস’ থেকে মানুষ যখন ‘ফিজিক্যাল অফিস’-এ ফিরে আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ার চাহিদা দ্রুত হ্রাস পায়। ফলে কোভিডকালীন নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা হঠাৎ করেই মেটার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রতীয়মান হতে শুরু করে। আর তাতেই, কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হয় মেটা।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। গত এক-দুই বছরে মেটা ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বিশাল পরিমাণ কর্মী নিয়োগ করেছে, এমনটা শোনা যায়নি। আবার এটা ধরে নেওয়াও যুক্তিসঙ্গত নয় যে, কোভিডকালীন নিয়োগপ্রাপ্তদের ‘ইনস্টলমেন্টে’ ছাঁটাই করা হচ্ছে।
তাই এবারের ৫ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণ যদি আসলেই ‘পারফরম্যান্স’ হয়, তাহলে কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত কর্তাব্যক্তিদের পারফরম্যান্সের মূল্যায়নও জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখতে পারেন জাকারবার্গ।
কর্মী ছাঁটাইয়ের পেছনে কি মেটার নীতিমালা?
সংখ্যা ছাড়া আরও কয়েকটি কারণে মেটা’র কর্মী ছাঁটাইয়ের এবারের সিদ্ধান্তকে শুধুই পারফরম্যান্সের লেন্সে দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালায় বেশ কয়েকটি বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন জাকারবার্গ। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছাকাছি যেতে, তাঁর সুরে সুর মেলাতে, জাকারবার্গের সাম্প্রতিক মরিয়া সব প্রচেষ্টারই অংশ এই পরিবর্তনগুলো।
গত ৭ জানুয়ারি জাকারবার্গ মেটার ৩ প্ল্যাটফর্ম–ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও থ্রেডসে ফ্যাক্টচেকিং বাতিল করে কমিউনিটিকেন্দ্রিক সেন্সরশিপ চালুর ঘোষণা দেন। সেন্সরশিপের এই কৌশল ইলন মাস্কের বই (পড়ুন এক্স প্ল্যাটফর্ম) থেকেই নিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, এক্সে ‘কমিউনিটি নোটস’ মডেল অনুসরণ করা হয় সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে, যেখানে কনটেন্ট মডারেশনের দায়িত্ব থাকে প্ল্যাটফর্মের অনুমোদিত ব্যবহারকারীদের ওপরই।
সেন্সরশিপ ইস্যুতে ‘ফ্যাক্টচেকিং’ ছেড়ে মাস্কীয় ‘কমিউনিটি মডেল’-কে আপন করে নেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে জাকারবার্গ বাকস্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা যতই বলুন না কেন, আদতে তিনি যে ট্রাম্প ও তাঁর ডানপন্থী অনুসারীদের তুষ্টি সাধনের মাধ্যমে নিজের ক্রমশ-সংকুচিত স্বাধীনতাকেই পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন, সেটাকে প্রযুক্তি বিশ্বে এখন আর ‘গোপন খবর’ বলে চালানো যাচ্ছে না।
ফ্যাক্টচেকিং বাতিলের অর্থই হচ্ছে থার্ড-পার্টি ফ্যাক্টচেকারদের বিদায় দেওয়া। তবে ৩৬০০ কর্মীর মধ্যে ফ্যাক্টচেকার আছেন কিনা, থাকলেও কত জন–এ বিষয়ে কিছু জানায়নি মেটা। তবে ফ্যাক্টচেকিং ইস্যুতে দুদিন আগে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে মেটা। তারা জানিয়েছে, ফ্যাক্টচেকার মুক্ত করার সিদ্ধান্ত আপাতত আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। কারণ, আমেরিকার বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে ফ্যাক্টচেকিংমুক্ত রাখা এতটা সহজ নয়।
মেটার নীতিমালায় আরেকটি বড় পরিবর্তন হচ্ছে, তাদের ডাইভারসিটি, ইক্যুয়িটি ও ইনক্লুশন বা ডিইআই প্রোগ্রাম বাতিল। এই পরিবর্তনের পেছনেও ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীদের প্রভাব যে সবচেয়ে বেশি, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে পেছনের কারণ যা-ই হোক না কেন, প্রশ্ন হচ্ছে ডিইআই টিমের কর্মীদের কী হবে? এ ক্ষেত্রে অবশ্য মেটা ইঙ্গিত দিচ্ছে, ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের অন্যত্র কাজে লাগানো হবে। এই যেমন, প্রধান ডাইভারসিটি অফিসার ম্যাক্সিন উইলিয়ামস এবার থেকে ‘অ্যাক্সেসিবিলিটি অ্যান্ড এনগেজমেন্ট’ বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছে মেটা।
জাকারবার্গের এআই স্বীকারোক্তি যে বার্তা দিচ্ছে…
সম্প্রতি (১০ জানুয়ারি) জনপ্রিয় পডকাস্টার জো রোগানের পডকাস্ট শোতে অংশ নিয়ে জাকারবার্গ জানিয়েছেন, একজন মিড লেভেল ইঞ্জিনিয়ারের মতো কোডিং করার সক্ষমতা অর্জন করবে এআই। ফলে ২০২৫ সালেই মেটা’র মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মিড লেভেল ইঞ্জিনিয়ারদের জায়গা নিতে পারে অত্যাধুনিক এআই প্রযুক্তি। অর্থাৎ, প্রতিদিনকার কোডিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মানুষের পরিবর্তে অচিরেই এআই দিয়ে করানো হতে পারে মেটায়।
জো রোগানের শোতে জাকারবার্গের এই মন্তব্য স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে, মিড লেভেল ইঞ্জিনিয়াররা এআইয়ের কাছে চাকরি হারাতে চলেছেন বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে, যার মধ্যে আছে মেটা-ও।
তাই পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে কর্মী ছাঁটাই কতটা নতুন প্রতিভার অন্বেষণে, আর কতটা ব্যয় সংকোচনে, তার উত্তর না হয় সময়ের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, সিএনএন, ডয়েচে ভেলে, এপি, দ্য ইকোনোমিক টাইমস