কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অবশেষে স্বপ্ন পূরণের পথে চীনের লাখ লাখ তরুণ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ‘গাওকাও’ ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে দেশটির প্রায় ৪৮ লাখ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তবে এই প্রতিযোগিতায় বাদ পড়েছে ৮০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। আর যারা সুযোগ পেয়েছে, তাদের অনেকে ভবিষ্যত নিশ্চয়তার খোঁজে ছুটছে এক দিকেই– প্রকৌশল।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট এক নিবন্ধে বলছে, চীনে এখন অর্ধেকের বেশি তরুণ-তরুণী কোনো না কোনো উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করছে। পুরো দেশজুড়ে রয়েছে তিন হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ। এত শিক্ষার্থী আর এত ডিগ্রির ভিড়ে প্রতিযোগিতা যেমন বেড়েছে, তেমনি কমেছে ডিগ্রির মূল্য। এর মধ্যেই অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে, এমনকি স্নাতকদের মধ্যেও। গত মে মাসে শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ।
চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকতে তরুণরা চাইছে এমন কিছু পড়তে, যেটি চাকরির নিশ্চয়তা দেয়। সেই তালিকায় এখন শীর্ষে রয়েছে প্রকৌশল। ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ৩৬ শতাংশই বেছে নিয়েছে এই বিষয়। ২০১০ সালে এ হার ছিল ৩২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে এ হার মাত্র ৫ শতাংশ।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, প্রকৌশল কেবল শিক্ষার্থীদের পছন্দ নয়, সরকারেরও সক্রিয় প্রভাব রয়েছে এতে। শুরু থেকেই চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির হাতে শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষ পদে থাকেন পার্টির অনুগতরা, আর অর্থায়নের বড় অংশ আসে সরকারি তহবিল থেকে। দলটির নেতৃত্বেও অনেক প্রকৌশলীও রয়েছেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং নিজেও একজন প্রকৌশল বিদ্যার মানুষ। তাই তরুণদের এই খাতে টেনে আনতে সরকার আগ্রহী।
২০২৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন তারা ডিগ্রির কাঠামো বদলে কৌশলগত ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে গুরুত্ব দেয়। চালু করা হয় ‘জরুরি ডিগ্রি’ তৈরির ব্যবস্থা। এরই মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ড্রোন, উড়ন্ত গাড়ি কিংবা চিকিৎসা যন্ত্র তৈরির মতো বিষয়ের ওপর শুরু হয়েছে নতুন কোর্স। এখন ৬০০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি চালু হয়েছে চীনে।
বেইজিংয়ের শিক্ষা পরামর্শক জিয়াং শুয়েচিন বলছেন, অনেক অভিভাবক মনে করেন, সরকার কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিলে ভবিষ্যতে সেই খাতে চাকরির সুযোগ বাড়বে। তাই সন্তানদের তারা এসব বিষয় পড়তে উৎসাহ দেন। সরকার প্রকৌশল বিদ্যায় গুরুত্ব দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা এখন প্রকৌশলের পেছনে ছুটছেন।
দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে, যে বিষয়গুলোকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে সরকার, সেগুলোর অবস্থা অকার্যকর মনে করছেন অনেকে। গত পাঁচ বছরে পাঁচ হাজারের বেশি কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি কিংবা ইংরেজির মতো বিষয়ে ভর্তির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সাংহাইয়ের নামী ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় মানবিক শাখায় ভর্তি কমিয়ে দিয়ে নতুন প্রযুক্তিনির্ভর কোর্স চালু করেছে। সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়েছে সংগীত, ইনস্যুরেন্স ও টেলিভিশন স্টাডিজের মতো বিষয়।
তবে মানবিকের মধ্যে একটি বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে– মার্কসিস্ট স্টাডিজ। পার্টির শাসনকে গৌরবময়ভাবে তুলে ধরতে এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে এই বিষয়। গত দশকে চীনে মার্কসবাদ নিয়ে যেসব কলেজে পড়ানো হয় সে সংখ্যা ১০০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৪০০ তে দাঁড়িয়েছে। শি জিন পিংয়ের রাজনৈতিক দর্শন নিয়েও তৈরি হয়েছে গবেষণা কেন্দ্র। আর এসব কোর্স দ্রুত বন্ধ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই বললেই চলে।