প্রত্নতাত্ত্বিক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মিলেছে যশোরের মণিরামপুরের ধনপোতা ঢিবিতে। ধারণা করা হচ্ছে সনাতন অথবা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হতে পারে এ প্রার্থনাস্থলটি। ঢিবিটি খননকালে পোড়া মাটির টেরাকোঠা বল, চুন রাখার পাত্র, কাঁচের চুরি, লৌহ জাতীয় শলাকা, নকশাকৃত ইটের সন্ধান মিলেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন জানান, প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর সাথে মনিরামপুরের দমদম পীরের ঢিবি, কেশবপুরের ভরত ভায়না, ডালিঝিরা ঢিবি এবং খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনি প্রত্নস্থানের মিল রয়েছে।
ইয়াসমিন আরো জানান, ২০২৩ সালের ১০ ডিসেম্বর ধনপোতা ঢিবির আনুষ্ঠানিক খননকাজ শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ। ঢিবিটিতে মোট ২০ টি কূপ খনন করা হবে। যার মধ্যে ১০টি কূপ খননে ইটের বেশ কয়েকটি চওড়া দেয়াল বেরিয়ে এসেছে। প্রাচীন স্থাপনার এই অংশগুলো ছাড়াও পাওয়া গেছে মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, পাথরের টুকরা, বাটি, পশুর হাড় ও লোহার পেরেক।
লাভলী ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, তা দিয়ে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। চলতি বছরও খনন কাজ চলবে। এরপর হয়ত আমরা একটি উপসংহারে পৌঁছাতে পারবো।’
ধনপোতা ঢিবি সংলগ্ন স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ ছলেমান বলেন, ‘তিনি তার পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছেন এখানে বিরাট রাজার বাড়ি ছিল। পাশাপাশি আরও দুইটি ঢিবি রয়েছে।’
স্থানীয় মনোরঞ্জন বিশ্বাস জানান, জনশ্রুতি রয়েছে স্বরুপ নদীর পাড়ে ধনপতি সওদাগার নামে এক প্রভাবশালির বাড়ি ছিল। আবার অনেকেই মনে করেন এই ঢিবিগুলি প্রাক ঐতিহাসিকযুগে প্রতাপশালী বিরাট রাজার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। মহাভারতের বিরাট অংশের কাহিনীতে পঞ্চপান্ডব যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব এবং তাদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদীকে নিয়ে এই বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। শকুনি মামা গান্ধার রাজের চক্রান্তে পাশা খেলায় হেরে যাওয়ার শর্তানুযায়ী পঞ্চপান্ডব ও তাঁদের একমাত্র স্ত্রী ধ্রুপদীকে নিয়ে ১২ বছর বনবাসে ছিলেন। তারা স্বরুপ নদীর তীরে বিরাট রাজার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মহাভারতের বিরাট কাহিনীর অংশের সাথে এটির মিল পাওয়া যায়।
মনোরঞ্জন বিশ্বাস জানান, তাঁর ঠাকুর দাদা কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস এক সময় অসুস্থ্য হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিলেন। তাকে ঝোলায় করে কলকাতায় চিকিৎসা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগ নিরাময় না হওয়ায় তাঁকে বাড়িতে ফেরত আনা হয়। এক রাতে তাকে স্বপ্ন দেখানো হয়, বাড়ির পাশে এক বাগানে প্রাচীন বৃক্ষের নীচে রেখে আসার কথা বলা হয়। তাঁর স্বপ্ন অনুযায়ী ওই বৃক্ষের নীচে রেখে আসেন। তখন ওই বাগানে বনশুকোর, বাঘসহ নানা হিংস্র পশুর বাস ছিল। কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুস্থ্য হয়ে উঠেন। পরে সুস্থ্য হয়েও তিনি ওই বৃক্ষের নীচে বসবাস করতে থাকেন এবং ধ্যান করতেন। এখনো ধনপোতা ঢিবির পশ্চিমে খেদাপাড়া বাজার সংলগ্ন বৈদ্যনাথ ধামে ওই বৃক্ষের গোড়ার অংশ রয়েছে।
স্থানীয় কালীদাস জানান, মহাভারতে শিব আশ্রিত যে গাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে এই প্রাচীন বৃক্ষের অবশিষ্টাংশের মিল খুঁজে পান স্থানীয় অনেকেই। বর্তমানে এই বৈদ্যনাথ ধামের এই প্রাচীন বৃক্ষের গোড়ার অংশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূজা-অর্চনা করে থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, ধনপোতা ঢিবির পাশের বিল খুড়লেই প্রাচীন নৌকার অংশ বিশেষসহ নানা ধরনের জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। এতে স্থানীয়রা মনে করেন এই বিল এক সময় নদী ছিল। যা মহাভারতে উল্লেখিত স্বরুপ নদী বলে মনে করা হয়। আর এই নদীর তীরে ছিল বিরাট রাজার বাড়ি।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলী বলেন, ‘সরকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাটির নিচে পড়ে থাকা সম্পদ খুঁজে বের করতে নানা ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করছেন। এতে করে হাজার বছরের আগের প্রত্নতাত্ত্বিক নানা ধরনের বস্তু উন্মুক্ত হচ্ছে। দেশের আপামর জনসাধারণ প্রাগ ঐতিহাসিকসহ শত শত বছরের নানা নিদর্শনের রহস্য সম্পর্কে জানতে পারছে।’
সংসদ সদস্য ইয়াকুব আলী আরো বলেন, ‘ধনপোতা ঢিবির পাশাপাশি মনিরামপুরে আরও কয়েকটি স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। দ্রুত সেগুলো চিহ্নিত করে খনন কাজ শুরু করা হবে। পরে সেগুলো সঠিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে দর্শনীয় স্থানে রুপ দেওয়া হবে এবং সকলের জন্য উন্মোক্ত করা হবে।’