মানুষের নানা ধরনের স্বপ্ন থাকে। কারও ধনী হওয়ার খায়েশ হয়, কারও থাকে বিনা আয়াসে উন্নতির শখ। তবে সবারই মোটামুটি একটা সাধারণ বাসনা থাকেই। বয়স বাড়লে সেই বাসনা সংক্রান্ত আফসোস যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ে। সেটি হলো তরুণ থাকার বাসনা। খেদের সঙ্গে মনে টোকা দেয়—‘ইশ্, বয়সটা যদি কমে যেত’ কিংবা ‘ইশ্, ওর মতো যদি হওয়া যেত!’
এই ‘ওর মতো’ হতে গিয়েই নিজেকে হারিয়ে ফেলি আমরা। কখনো পরিবার বলে ওর মতো হতে, কখনো সমাজ। আবার কখনো নিজেই হতে চাই তেমন। সারা দুনিয়ায় এই ‘ওর মতো’ হওয়ার চাপ নারী-পুরুষ, দুইয়ের প্রতিই থাকে। তবে নারীর ওপর একটু বেশিই। কারণ দিনশেষে সব সমাজই যে কম-বেশি পুরুষতান্ত্রিক। তাই পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিটাও আলগা চাপ হয়ে জেঁকে বসে নারীর ওপর। আবার অনেক সময় নারীরাও মানসিকভাবে পুরুষ হয়ে উঠে অন্য নারীর ওপর জোর খাটায়। পুরুষের তুলনায় নারীর প্রতি আলাদা একটি কৃত্রিম দৃষ্টিভঙ্গিও চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেটি হলো সৌন্দর্যবিষয়ক। নারীকে আসলে কার চোখে সুন্দর হওয়ার চাপ দেওয়া হয়? পুরুষের মতো করে নয় কি?
এমন একটি সমাজের কথাই বলে ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। পরিচালনায় ছিলেন কোহালি ফাহ্জা। ফরাসি এই পরিচালক আবার সিনেমাটির গল্পও লিখেছেন। প্রায় সাড়ে ১৭ মিলিয়ন ডলার বাজেটে তৈরি এই সিনেমা বক্স অফিসেও ভালো ব্যবসা করেছে। বিশ্বব্যাপী আয় করেছে ৭৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সিনেমা হলে মুক্তির পর এরই মধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মেও মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’। দেখা যাচ্ছে প্রাইম ভিডিওতে।
আরও পড়ুন:
প্রায় ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সাই-ফাই হরর ঘরানার। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির নানা গ্রাফিক্যাল চমকের চেয়ে মানুষের জীবনটাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। স্যাটায়ার এলিমেন্টসও আছে ভালোমতোই। সিনেমা হলে ব্যবসার মাধ্যমে সাধারণ দর্শকদের যেমন বিনোদিত করেছে ছবিটি, তেমনি জিতে নিয়েছে সমালোচকদের হৃদয়ও। আগামী ২ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ৯৭তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কারের আসরে সেরা ছবি ও সেরা পরিচালকসহ মোট ৫টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’।
এই সিনেমার গল্পে মূল চরিত্র এলিজাবেথ স্পার্কেল নামের একজন তারকা। এই সমাজ তাকে বুঝিয়ে দেয় যে, বয়সের সাথে সাথে তার রূপ-লাবণ্য কমেই গেছে। তাই টেলিভিশন চ্যানেলের বড় কর্তাও এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এলিজাবেথকে সরিয়ে দিতে চায়। আনতে চায় নতুন মুখ, তরুণ শরীর, যাতে করে শরীরচর্চানির্ভর শো-তে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর ঠিক সেই সময়টায় নড়ে যায় এলিজাবেথের আত্মবিশ্বাসও। নিজেকে তরুণ করার আকাঙ্ক্ষায় কালোবাজারের এক নিষিদ্ধ ওষুধ নিতে মরিয়া হয়ে পড়ে এলিজাবেথ। নিয়েও নেয়। আর তখনই জন্ম হয় এলিজাবেথের তরুণ সংস্করণের, নাম হয় তার স্যু। কিন্তু এক শরীর থেকে জন্ম নিয়েও তৈরি হতে থাকে দুটি ভিন্ন সত্তা। এলিজাবেথ ও স্যু হয়ে পড়তে থাকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ।
আরও পড়ুন:
এ লেখার শুরুতে ‘ওর মতো’ হওয়ার প্রসঙ্গটি ছিল। আমরা এই পুঁজিবাদী পৃথিবীতে দিনকে দিন ‘ওর মতো’ হতে গিয়েই আসলে জীবন পার করে দিচ্ছি। এই ‘ও’ অনেক বেশি আদর্শ বলে প্রচার আছে। কিন্তু আসলেই কি নিখুঁত বলে দুনিয়ায় কিছু হয়? তবুও আমাদের যাত্রা সেদিকেই। আর বারংবারের এমন চেষ্টায় আমরা ‘ওর মতো’ তৈরি হয়েও যাচ্ছি বটে কিছুটা। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আসল কথাটাই ভুলে যাওয়া হচ্ছে। সেটি হলো, ‘ও’ আসলে আমাকে দিয়েই তৈরি। আমিই আসল, ‘ও’ মুখোশ। আমাকে দিয়েই ‘ও’ চলে। যাবতীয় জীবনীশক্তি আসে আমি থেকেই। অথচ ‘ও’ একসময় কোণঠাসা করে দেয় ‘আমি’কেই। বলতে থাকে, ‘আমি’ না থাকলেও নাকি চলবে!
নারীদের ক্ষেত্রে এই ‘ও’কে চাপিয়ে দেওয়া হয় আরও বেশি করে। সেটি সমাজ করে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাকে অবলম্বন করেই। চিন্তা-ভাবনায় কুৎসিত পুরুষও একজন নারীর সৌন্দর্য কীসে হয়, সেটি নির্ধারণ করতে বসে যায়। অনেক ক্ষেত্রে নির্ণায়ক নির্ণিত হয় শরীরী মাপে। এরপর ধীরে ধীরে তার জগদ্দল ভার চেপে বসে নারীর ওপর। ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ সিনেমাতে ঠিক সেটিই তুলে ধরা হয়েছে সুচারূভাবে।
আরও পড়ুন:
বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ফোর্বস এই ছবিটি সম্পর্কে লিখেছে যে, ‘দ্য সাবস্ট্যান্স-এর পুরুষেরা এক কার্টুন চরিত্রের মতো করে নারীর বস্তুগত মূল্যায়ন করে। শেষে নারীরাই ভেঙেচুরে যায়। নারীরা একে-অপরের ওপর সহিংস হয়ে ওঠে। নারীদেরই সবচেয়ে চড়া মূল্য চোকাতে হয়। এবং এই সবকিছুই হয় কতিপয় মানুষ ও সমাজের কথিত প্রধান অংশের বিনোদনের নিমিত্তেই কেবল।’
‘দ্য সাবস্ট্যান্স’-এর গল্প ও চিত্রনাট্য এতটাই মৌলিক ও গভীর চিন্তাবহ যে, এর আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অভিনয়শিল্পীদের কৃতিত্ব। মূল চরিত্র এলিজাবেথ স্পার্কেল হিসেবে ছিলেন ডেমি মুর। এ যেন এক অন্য ডেমি মুর! এত বাস্তবানুগভাবে তিনি পর্দায় এলিজাবেথের শরীর ও মনের বিভিন্ন পর্যায়কে তুলে ধরেছেন যে, মুগ্ধ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এরই মধ্যে এই চরিত্রের জন্য সেরা অভিনেত্রীর বেশক’টি পুরস্কারও তিনি বগলদাবা করে ফেলেছেন। এলিজাবেথের আরেক সত্তা স্যু হিসেবে ছিলেন মার্গারেট কোয়ালি। উদ্ভবের পর থেকে বাকি সিনেমাজুড়েই মার্গারিট ছিলেন অনবদ্য। আর টেলিভিশন চ্যানেলের বড় কর্তা তথা পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে থাকা হার্ভিরূপী ডেনিস কুয়েইড ছিলেন অসাধারণ। পুরুষতন্ত্রের বিষাক্ততা ফুটিয়ে তুলেছেন ত্রুটিহীনভাবে।
‘দ্য সাবস্ট্যান্স’-এর সিনেমাটোগ্রাফি ও আবহসংগীত দারুণ। স্পেশাল ইফেক্টস যতটুকুই ছিল, নিখুঁত ছিল। তবে হ্যাঁ, শেষের দিকে সিনেমাটির দৈর্ঘ্যজনিত ক্লান্তি দর্শকদের মনে ভর করতে পারে। এর দৈর্ঘ্য ৩০ মিনিট কম হলেও মন্দ হতো না। বরং তখন সিনেমার প্রথমার্ধের টানটান বিষয়টি ধরে রাখা যেত সহজে।
তবে সবচেয়ে চমকে দেওয়ার মতো বিষয় হলো এই সিনেমার প্লট। মেটাফর এতে বেশি। সেগুলোর আবার সংযোগ ঘটানো যায় বর্তমান মানবসমাজ ও সভ্যতার নানা কিছুর সাথে। কখনো কখনো রক্তে সব ঢেকে যায়, ন্যুডিটিও আসে প্রাসঙ্গিকভাবেই। আবার ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’ মাঝেমাঝেই প্রচণ্ড অগোছালো, অযৌক্তিক। পরক্ষণেই দারুণ গোছানো রূপ চোখে পড়ে। এক কথায়, এই সিনেমা পাগলাটে, বুনো, বীভৎস এবং একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর সুন্দরও বটে।
দেরি না করে তাই দেখে ফেলতেই পারেন ‘দ্য সাবস্ট্যান্স’, ঘুরে আসতে পারেন এক অন্য দুনিয়া থেকে। সিনেমা শেষের পরও ওই অন্য দুনিয়া আপনাকে তাড়া করে ফিরবে, তা নিশ্চিত!