‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’—নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের বেশ জনপ্রিয় সংলাপ এটি। কিন্তু কখনও কি একটি মানুষকে আমূল বদলে যেতে দেখেছেন? যেমন, কেউ যদি পুরুষ থেকে নারী হয়ে যান! কিংবা নারী থেকে পুরুষ? কিন্তু তার বেঁচে থাকা পুরনো অনুভূতির মাঝেই!
আসন্ন ৯৭তম অস্কারে সেরা ছবির মনোনয়ন পাওয়া ‘এমিলিয়া পেরেজ’ সিনেমায় তেমনই এক অভিনব ঘটনা চিত্রায়িত হয়েছে। মূল গল্প আবর্তিত হয়েছে মেক্সিকোর এক শীর্ষ মাদক সম্রাটকে কেন্দ্র করে, যার নাম মানিতাস দেল মন্তে। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর বেশকিছু সাক্ষাৎকারে ‘নারী’ হয়ে জন্ম নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। এই সিনেমায়ও তেমনটা দেখা যায় মাদক সম্রাট মানিতাসের ক্ষেত্রে। অপরাধের বেড়াজালে জড়িয়ে তার জীবন যখন বিপন্নপ্রায়, তখন বিপদ এড়াতে সে বেছে নেয় ছদ্মবেশী এক জগত! নারীর জীবন!
মানিতাসকে এই রূপান্তরে সহায়তা করে ‘রিতা মোরা ক্যাস্ত্রো’ নামের এক জনপ্রিয় আইনজীবী। যে কিনা সম্প্রতি এক মার্ডার মামলায় জিতে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। নানা ঘটনা পরম্পরায় এগোতে থাকে সিনেমাটির গল্প। মেক্সিকোর গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের নানা শহরে ছড়াতে থাকে গল্পের ডালপালা।
মিউজিক্যাল থ্রিলারধর্মী এ সিনেমা দেখতে বসলে, ‘লা মিজারেবল (২০১২)’র কথাও মনে পড়ে যেতে পারে কোনো কোনো দর্শকের কিংবা অন্য আরও সিনেমার কথা! আসলে যেকোনো মিউজিক্যাল ফিল্মের চরিত্রগুলো গানের পাখি, তারা কথা বলে গানে গানে! আর আবহ সংগীতের ভেতর দিয়ে দর্শকদের নিয়ে যায় অজানা এক শৈল্পিক ভ্রমণে!
শুরুতে আইনজীবী রিতার মনস্তাত্ত্বিক জগতকে ফুটিয়ে তুলেন ফরাসি নির্মাতা জ্যাক অঁডিয়ার। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন জো সালদানা। এবারের অস্কারে পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। পর্দায় সব দেখে-শুনেও কপটতার বিরুদ্ধে মুখ ফুটে বলতে না পারার এক যন্ত্রণাকাতর অনুভূতি ফুটে উঠে তাঁর চরিত্রে। যেন তিনি যিশু! সকল দুঃখবোধের সাক্ষী।
তবে সিনেমাটি নতুন মাত্রা লাভ করে যখন মাদক সম্রাট মানিতাস সার্জারির মাধ্যমে নারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। দেখা যায়, এই পরিবর্তনের পরেও তার অনুভূতিগুলো আগের মতোই সক্রিয়। কিন্তু তা ব্যক্ত করায় যত বিপত্তি! এমনকি ভালোবাসার স্ত্রী জেসি ও আদরের দুই সন্তানের কাছেও সেসব অপ্রকাশিত! সিনেমাটি তখন আরও গভীর আবেগময় হয়ে উঠে।
মানিতাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ট্রান্সজেন্ডার অভিনেত্রী কার্লা সোফিয়া গ্যাসকন। গোটা সিনেমা জুড়ে তাঁর অভিনয় বিস্ময়কর! সেরা অভিনেত্রী বিভাগে অস্কার পাওয়ার যোগ্য দাবিদার তিনি। অন্যদিকে, মাদক সম্রাটের স্ত্রী জেসির ভূমিকায় রয়েছেন অভিনেত্রী-গায়িকা সেলেনা গোমেজ। এর আগেও বিভিন্ন সিনেমায় তাঁকে দেখা গেছে, কিন্তু এমন স্বতস্ফূর্ত অভিনয় খুব একটা চোখে পড়েনি।
সংগীত, নৃত্য আর অভিনয়—সব মিলিয়ে এমলিয়া পেরেজকে অনন্য করে তুলেছেন নির্মাতা জ্যাক অঁডিয়ার। যেখানে বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক অবসাদ উন্মোচনের পাশাপাশি দুর্নীতিগ্রস্ত এক সমাজব্যবস্থায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, মায়া-মমতা, প্রেম, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার মতো বিষয়গুলোর ওপর আলো ফেলেছেন তিনি।
তবে এই সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল দিক বলতে গেলে সিনেমাটোগ্রাফি। যেখানে খুব একটা কারিগরির দেখা মেলেনি। যদিও প্রতিটি দৃশ্যে আলোর খেলা ছিল লক্ষ্যনীয়। এ ছাড়া মিউজিক্যাল সিনেমা হিসেবে মৌলিক গান ব্যবহারেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন জ্যাক অঁডিয়ার। এর মধ্যে ‘এল মাল’ গানটি উল্লেখযোগ্য বটে। তা ছাড়া দুটি ভিন্ন মানুষ হিসেবে সোফিয়া গ্যাসকনের মেকআপও দৃষ্টিনন্দন।